
বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণ। আর এই পার্বণের পালে যেই উৎসব সব থেকে বেশি হাওয়ার ভর জোগায় তা হল দুর্গা পুজো। পুজো মানেই নতুন এক ভোর-নতুন এক আউল বাউল গন্ধ। সপ্তমী থেকে পুজোর শুরু দশমীতে শেষ। মাত্র চারদিনের এই যাত্রাপথে বাঙালিরা মেতে ওঠে, এক আলো মাখা খেলায়। বিশ্ব জুড়ে যেখানেই বাঙালি, এই চারটে দিন যেন মহামায়ার কোলে আশ্রয় পাওয়ার অবকাশ। দশমী এলেই বুক ভারী, চোখে জল! বিসর্জনের ঢাকের তালে মায়ের তখন জল সাঁতরে চলে যাওয়ার তাড়াটাই যেন বেশি!
দশমী আর সিঁদুর খেলা একে অন্যের সমার্থক। মহিলাদের সিঁদুর খেলার মধ্যে দিয়েই প্রাক বিসর্জন প্রস্তুতি শুরু। মাকে বিদায় জানানোর সময় সিঁদুর খেলা তো জমে ওঠেই, কিন্তু বহু মহিলার তারপরেই ভোগান্তির শিকার হতে হয়। অত্যাধিক সিঁদুর খেলার শেষে অনেককেই পড়তে হয় ভয়াবহ সিঁদুর অ্যালার্জির কবলে। যাদের ত্বক স্পর্শকাতর তাঁদের মুখে-গালে সিঁদুর লাগলেও, ধীরে ধীরে সেই সব স্থান থেকে ফুসকুড়ি, র্যাশ ছড়িয়ে পড়ে শরীরের অন্যান্য অংশে, এবং তারসাথে অসম্ভব রকমের গা চুলকানো তো আছেই! যাদের ত্বক স্বাভাবিক এবং স্পর্শকাতর নয় তাঁদেরও সিঁদুর খেলার পর অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে। যেই সিঁদুর দিয়ে খেলা হচ্ছে, তার বিশেষতায় নির্ভর করছে সবটা, অর্থাৎ সিঁদুরে থাকা উপকরণের উপর।
সিঁদুর খেলার পর দেখা দেওয়া উপসর্গ
ডায়মন্ড হারবার গর্ভমেন্ট মেডিকেল কলেজের কনসালটেন্ট চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এবং কসমেটোলজিস্ট, সহকারী অধ্যাপক এবং এইচওডি, ডাঃ মহিমাঞ্জন সাহা হ্যাপিয়েস্ট হেলথ-কে দেওয়া সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, সিঁদুরে থাকে মূলত লেড অক্সাইড এবং মার্কারি সালফাইড যা অতিমাত্রায় বিষাক্ত। সিঁদুর খেলায় একজন মহিলা যখন অন্যের মুখে বা গালে সিঁদুর লাগিয়ে দেন, তখন তার থেকে কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস হতে পারে। ডাঃ সাহা আরও জানান, কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস দুই প্রকারের, ইরিট্যান্ট কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস এবং অ্যালার্জিক ডার্মাটাইটিস। সিঁদুর খেলার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ্যালার্জিক কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস দেখা যায়। এই প্রকারের চর্মরোগের বিশেষত্ব হল ফুসকুড়ি বা একজিমা। ত্বক লাল হয়ে ওঠে এবং সেই ফুসকুড়ি বা ঘামাচির মতন র্যাশ চুলকালে জলীয় পদার্থের নির্গমন হয়।
সিঁদুর খেলার সময় সাবধানতা
কলকাতার গৃহবধূ, তপতী গাঙ্গুলীর মতে, মহিষাসুরকে পরাস্ত করে মা দুর্গার জয়, অশুভ শক্তির নাশ এবং শুভ শক্তির উত্থান। বাংলার সব সধবা মহিলারাই দশমীর সিঁদুর খেলার আনন্দে মেতে ওঠেন। তবে তিনি জানিয়েছেন, লাল সিঁদুরে রাসায়নিক থাকায় তা খেলার সময় এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। অর্গানিক বা ভেষজ সিঁদুর দিয়েই আনন্দে মেতে ওঠা উচিত দশমীর এই দিনে।
তপতী নিজে সিঁদুর খেলার আগে, মাথায় তেল লাগান না, যারফলে খেলা শেষে চুল থেকে সিঁদুর ঝেড়ে ফেলে শ্যাম্পু করে নিতে তাঁর কোনও অসুবিধাও হয় না। সিঁদুর খেলার পর তাঁর নিজের কোনও অসুবিধা না দেখা দিলেও, সিঁদুর খেলা পরবর্তী ত্বক প্রদাহের অসুবিধা থেকে কেমন করে রক্ষা পেতে হবে, এই নিয়ে হ্যাপিয়েস্ট হেলথ থেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছেন, ভেষজ উপাদানের উপরই ভরসা রাখা এই ক্ষেত্রে সেরা উপায়। দই-মধু-হলুদের মিশ্রণ ত্বকে সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক আরামের জন্য দেওয়া যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, সিঁদুর খেলার আগে ময়েশচারাইজার মেখে খেলার এই আনন্দে তিনি অংশ নেন। যার ফলে সিঁদুর খেলার পরে গাল এবং মুখের থেকে লাল রং সহজে ওঠাতে তাঁকে কোনও অসুবিধায় পড়তে হয় না।
ডাঃ সাহার মতানুযায়ী, মূলত ভেষজ সিঁদুর এই খেলায় ব্যবহার করা ভাল। পলাশ ফুলের থেকেও আজকাল সিঁদুর তৈরী হচ্ছে যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন। এমন প্রাকৃতিক উপায়ে বানানো সিঁদুর, ত্বক রক্ষা করতে পারে। হ্যাপিয়েস্ট হেলথের তরফ থেকে সিঁদুর খেলার আগে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা হবে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ওষুধের দোকানে বিভিন্ন মেডিক্যাল ময়েশ্চারাইজার পাওয়া যায়,তা লাগানো যেতে পারে। তাছাড়াও, নারকোল তেল সিঁদুর খেলার আগে লাগানো ভাল, কারণ এই তেল ত্বকে এক আস্তরণ তৈরী করে যার ফলে সিঁদুরের ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রভাব অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব।
যদি সিঁদুর খেলতে খেলতেই শরীর চুলকানো শুরু হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে খেলা বন্ধ করে স্নান করে নেওয়া উচিত। ডাঃ সাহা মনে করিয়ে দেন, ত্বকের প্রদাহ দূর করার জন্য স্নান করলেও সাবান বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা যাবে না, কারণ সাবানে ক্ষার থাকায় তা ত্বকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি আরও বলেন, সিঁদুর খেলেই তাড়াতাড়ি গা ধুয়ে নেওয়া অথবা স্নান করে নেওয়া উচিত। সিঁদুর গায়ে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ থাকা চলবে না। এরপরেই ভাল দেখে ময়েশ্চারাইজার গায়ে লাগিয়ে নিতে হবে।
সিঁদুর খেলার পর অনেকসময় সংবেদনশীল ত্বকে প্রদাহ শুরু হয়। ডাঃ সাহাকে এই সময় কোন কোন ওষুধ খাওয়া যেতে পারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছেন, এই অবস্থায় সবসময় কোনও ত্বক বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নেওয়া উচিত। তাৎক্ষনিক আরামের জন্য সেট্রিজিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যদি আমবাত বা দেহে চাকা চাকা দাগ এবং গা লাল হয়ে যেতে শুরু করে, তবে সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে কোনও ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ অথবা নিকটবর্তী হাসপাতালে যাওয়া উচিত।
দুর্গা পুজোর দশমীতে সিঁদুর খেলা আনন্দের ও সম্প্রীতির এক অনন্য রূপ। দুর্গা ঠাকুরের বিসর্জনের সময় জল ভরা চোখ, সিঁদুরের প্রলেপ মাখা বাঙালি মহিলাদের মধ্যেই যেন জগজ্জননীর রূপ ফুটে ওঠে। অপার সৌন্দর্যময়ী বাঙালি বধূদের সেই রূপ অস্বীকারের কোনও জায়গাই নেই। তবে সিঁদুর খেলতে যাওয়ার আগে মনে রাখতে হবে ত্বকের স্বাস্থ্যের কথাও। নইলে সিঁদুর খেলার পরেও হতে পারে বড়সড় অঘটন। তাই নিয়ম মেনে সিঁদুর খেলুন। আনন্দে মাতার আগে খেয়াল থাক স্বাস্থ্যেরও।
সারসংক্ষেপ
- নারকোল তেল অথবা ময়েশ্চারাইজার সিঁদুর খেলার আগে ভাল করে মুখে এবং গলায় লাগিয়ে নিন
- সিঁদুর খেলেই ভাল করে গা ধুয়ে নিন। দীর্ঘ সময় ধরে সিঁদুর গায়ে নিয়ে থাকা যাবে না
- সিঁদুর খেলার পর গা চুলকানি শুরু হলে, স্নান করুন, কিন্তু সাবান না ব্যবহার করাই ভাল। সাবানে থাকা ক্ষার হিতে বিপরীত করতে পারে