
আনহেলদি ফ্যাট এবং ট্রান্স-ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবারের অতিরিক্ত ব্যবহার, প্রধানত আল্ট্রা প্রসেসড জাঙ্ক ফুড, গোটা বিশ্ব জুড়ে কার্ডিওভাসকুলার রোগকে বাড়িয়ে তোলার জন্য দায়ী। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে আপনার হৃদয়কে সুস্থ রাখার সবচেয়ে সহজ এবং সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল সক্রিয় জীবনধারার সাথে হেলদি হার্ট-ফ্রেন্ডলি ডায়েট অনুসরণ করা।
বেঙ্গালুরুর নিউট্রিশনিস্ট পলক টি পুনামিয়া, ব্যাখ্যা করেন যে খাবার এবং স্ন্যাকস হিসাবে হেলদি কিছু খাওয়ার অভ্যাস করাটাও গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমরা যে ছোটখাটো জিনিসগুলি খাই সেগুলোও কিন্তু অনেক কিছু বদল করতে পারে।
বেশিমাত্রায় অস্বাস্থ্যকর উপাদান দেওয়া যেমন স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাট, বা অতিরিক্ত নুন দেওয়া খাবার খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। এই খাবারগুলি খাওয়ার ফলে স্থূলতা এবং ডায়াবেটিসও হতে পারে যা আবার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
মুম্বইয়ের SRV হাসপাতালের কার্ডিওলজির কনসালট্যান্ট ডাঃ জয়দীপ রাজেবাহাদুর বলেন, “ভাল একটি ডায়েটে অবশ্যই সবুজ শাকসবজি, ফল আর হোল গ্রেনের মতো নিরামিষ জাতীয় খাবারের সাথে মুরগির মাংস, মাছ, ডিমের মতো আমিষজাতীয় খাবার মাঝে মাঝে গ্রহণ করে এক ভারসাম্য তৈরি করতে হবে।”
হৃদয় সুস্থ রাখতে যে খাবারগুলি আপনার না খাওয়াই ভাল
১. রেড মিট
চেন্নাইয়ের ফোর্টিস ম্যালার হাসপাতালের কার্ডিওথোরাসিক ভাস্কুলার সার্জন ডাঃ তেজস্বী এন মারলা ব্যাখ্যা করেন যে রেড মিটকে হার্টের জন্য খারাপ বলে মনে করা হয় কারণ এতে বেশি মাত্রায় LDL (লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা খারাপ কোলেস্টেরল) এবং ট্রাইগ্লিসারাইডস (এক ধরনের চর্বি) আছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে দীর্ঘদিন ধরে রেড মিট খেলে তা আপনার হৃদয়ের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। “তার পরিবর্তে আপনি মুরগির মাংস বা মাছ খেতে পারেন কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড আছে,” বলেন ডঃ রাজেবাহাদুর৷
ডাঃ মারলা আরও বলেন যে আমিষ জাতীয় কোনও খাবার খাওয়ার সময়, ত্বক ও অন্যান্য অঙ্গগুলি না খেয়ে শুধুমাত্র মাংস খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় কারণ সেগুলিতে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে।
২. ব্রেড এবং বেকারিতে তৈরি অন্যান্য আইটেম
পুনামিয়া ব্যাখ্যা করেন যে বাড়িতে বেক করা খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল কিন্তু আপনি যখন বাইরে থেকে কিছু কিনে খান, তখন সেগুলিকে প্রসেস করা হয় এবং সেগুলিতে রিফাইন্ড ফ্লাওয়ার (ময়দা) ব্যবহার করা হয় যা অস্বাস্থ্যকর এবং যাতে বেশি পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট থাকে। “তার পরিবর্তে হোল গ্রেন ব্রেড, ব্রাউন ব্রেড বা আটা ফ্রি ব্রেড খাওয়া যেতে পারে,” ডাঃ রাজেবাহাদুর বলেন।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন যে ব্রেড এবং অন্যান্য বেকারি আইটেমগুলিকে এড়িয়ে চলাই ভালো। “ব্রেডের শেলফ লাইফ বাড়ানোর জন্য এবং সেটিকে আরও তুলতুলে করার জন্য তাতে নুন ও অন্যান্য উপাদান মেশানো হয়,” ডাঃ মারলা বলেন। তিনি আরও বলেন যে এটি আপনার রোজকার বিপাক ক্রিয়ায় সমস্যার সৃষ্টি করবে এবং দীর্ঘ দিন ধরে খেলে তা আপনার শারীরিক ও বিপাকীয় স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করবে।
৩. আইসক্রিম এবং চকলেট
আইসক্রিম এবং চকোলেটে প্রচুর পরিমাণে চিনি, কার্বোহাইড্রেট এবং খারাপ চর্বি থাকে। “এগুলির বেশিরভাগই এম্পটি ক্যালোরি (যার নিউট্রিশনাল ভ্যালু সামান্য বা নেই) যা বার্ন করা কঠিন, এবং সময়ের সাথে সাথে এটি আপনার হৃদয়ের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে,” বলেন ডাঃ রাজেবাহাদুর। তিনি আরও বলেন যে আপনি মাঝে মাঝে চকলেট বা আইসক্রিম খেতেই পারেন, তবে তা আপনার খাদ্যাভ্যাস বা ডায়েটের অংশ হওয়া উচিত নয়।
ডাঃ মারলা আরও বলেন যে আইসক্রিম খাওয়ার ক্ষেত্রে মাসে একবার এক স্কুপ খাওয়ার সুপারিশ করা হয়। “যদিও আইসক্রিম কম করে খাওয়াই ভালো, তবে যেহেতু এটা প্যাক করা এবং প্রসেস করা, তাই আইসক্রিম না খাওয়াই ভালো,” বলেন পুনামিয়া৷
৪. তেল
বিশেষজ্ঞরা বলেন যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি আছে এমন তেল এড়িয়ে চলাই ভালো। যেমন, নারকেল তেলে বেশি মাত্রায় স্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে এবং তা আপনার LDL কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে পারে। “কোল্ড প্রেসড অয়েল (ভাল কোলেস্টেরল (HDL) -এর মাত্রা বাড়ায়) হৃদরোগজনিত সমস্যা আছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে একটি ভাল বিকল্প,” পুনামিয়া বলেন।
কিন্তু ডাঃ মারলার মতে, যে কোনো তেলেই অল্পস্বল্প পরিমাণে খারাপ আর পুরোপুরি ভালো তেল বলে কিছু নেই। তিনি আরও বলেন, রান্নায় যে তেলই ব্যবহার করা হোক না কেন, সেটিকে সীমিত পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে।
৫. নুন
“যতটা সম্ভব ততোটা কম করে নুনের ব্যবহার করা উচিত কারণ নুনের সোডিয়াম ক্লোরাইড রক্তনালীতে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি করে,” ডাঃ মার্লা বলেন।
পুনামিয়া আরও বলেন যে, যেহেতু হৃদয়ের সমস্যা আছে এমন ব্যক্তিদের সোডিয়াম এড়ানো উচিত, তাই তাদের নিশ্চিত করা উচিত যে তারা খাবারে বা ফলে স্বাদবর্ধনকারী বা সিজনিং হিসাবে নুন না দেন এবং তার বদলে সিজনিং হিসাবে ওরেগানো, লেবুর রস, কালো লঙ্কা বা সামান্য ভিনিগারের মতো ভেষজ পদার্থগুলির ব্যবহার করুন
৬. ফ্রোজেন, প্যাকড এবং ফাস্ট ফুড
পুনামিয়া বলেন, “আমরা যেসব ফাস্ট ফুড, প্যাকড এবং ফ্রোজেন ফুড কিনে থাকি তাতে MSG (মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট/ আজিনোমোটো) দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন যে ক্যানড ফুডেও প্রচুর সোডিয়াম থাকে যা হার্টের জন্য খারাপ।
রেডি টু ইট ফুড, প্যাকেজড জুস, ক্যানড ফুড, সল্টেড বাটার, ফাস্ট ফুড, প্রসেসড চিজ এবং প্রিজার্ভড মিট না খাওয়াই উচিত কারণ এতে কোলেস্টেরল ও কার্বোহাইড্রেট বেশি থাকে। সস এবং আচারও না খাওয়াই ভালো। “এগুলি কখনই ভাল বিকল্প নয় কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে নুন বা অন্যান্য প্রিজারভেটিভের মতো অবাঞ্ছিত পদার্থ দেওয়া থাকে,” বলেন ডাঃ রাজেবাহাদুর। তিনি আরও বলেন যে কখনও কখনও আমরা এই খাবারগুলিকে ভেজেও থাকি, তাই সেগুলি আরও বেশি অস্বাস্থ্যকর হয়।
৭. কন্দমূল যুক্ত শাকসবজি
বিশেষজ্ঞরা বলেন যে বেশিরভাগ কন্দমূলযুক্ত শাকসবজি যেমন ট্যাপিওকা, আলু, রাঙালু আলুতে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট এবং শর্করা থাকে। তাই, সাধারণত এগুলিকে এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ডাঃ মারলা বলেন, “যদি কারো পক্ষে তাদের ডায়েট থেকে এগুলিকে সম্পূর্ণরূপে সরাতে না পারে তবে সেগুলিকে ভাজার বদলে সেঁকে নিলে আরও ভাল হয়।” তিনি আরও বলেন যে এটি কারও প্রধান খাবারের একটা অংশ হতে পারে, তাই আমরা সুপারিশ করি যে তারা যেন এটিকে ভেজে নয় সিদ্ধ করে খান।
৮. চিনি
ডাঃ রাজেবাহাদুর বলেন যে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত যে কোনও খাবার খাওয়ার সুপারিশ করা হয় না কারণ দীর্ঘদিন এই ধরণের খাবার খেলে তা আপনার হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। চিনিযুক্ত পানীয় এবং চিনিযুক্ত খাবারও এড়িয়ে চলতে হবে।
“গুড়, ফ্রুক্টোজ, কর্ন সিরাপ এবং চিনির মতো সাধারণ শর্করা (সাধারণ কার্বোহাইড্রেট) এড়ানো উচিত,” পুনমিয়া বলেন। তিনি আরও বলেন যে তার পরিবর্তে, হোল গ্রেনস, শাকসবজির মতো জটিল কার্বোহাইড্রেটগুলিকে ডায়েটে যোগ করা উচিত।