
আমাদের শরীরে ‘হাই কোলেস্টেরল’ -এর মাত্রা প্রায়ই আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে এবং সেটির জন্য আমাদেরকে কিছু করার আগে ভেবে চিনতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমাদের হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য অতিরিক্ত চর্বিকে কম করার বা যেসব খাবারদাবার বেশি রকমের তৈলাক্ত সেগুলিকে অবিলম্বে কম করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এখানে ‘কোলেস্টেরল’ শব্দটি এমন একটি ক্ষতিকারক চটচটে পদার্থের সাথে যুক্ত যা আমাদের ধমনীকে ব্লক করে, হার্টের ক্ষতি করে। যা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই সেটা হল ভাল কোলেস্টেরল বা HDL (হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন) বলেও একটি কোলেস্টেরল রয়েছে যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধরণের কোলেস্টেরল (HDL, LDL, VLDL) এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মধ্যে, HDL -এর ক্ষতিকারক LDL (লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন)বা খারাপ কোলেস্টেরলকে ধমনী থেকে সরিয়ে ফেলার ক্ষমতা থাকার কারণে HDL -কে ‘ভাল কোলেস্টেরল’ বলা হয়।
বেঙ্গালুরুর ব্যানারঘাটা রোডের ফোর্টিস হাসপাতালের ডিরেক্টর এবং ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, ডঃ রাজপাল সিং -এর মতে, HDL হল প্রতিরক্ষামূলক কোলেস্টেরল যা ‘স্ক্যাভেঞ্জার’ বা ঝাড়ুদার’ কোষ হিসাবে কাজ করে এবং বেশি মাত্রার LDL কোলেস্টেরল আছে এমন কাউকে LDL -এর ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে রক্ষা করে। হ্যাপিয়েস্ট হেলথের সাথে কথা বলতে গিয়ে, কার্ডিওলজিস্টরা ব্যাখ্যা করেন কীভাবে HDL-এর একটি আকাঙ্খিত স্তর সর্বদা একটি সুস্থ হৃদপিন্ডের পূর্বনির্দেশক হয় এবং আপনি কী খাচ্ছেন তার উপর নজর রাখার ও নিজেকে শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখার মাধ্যমে তা অর্জন করা যেতে পারে।
আমাদের হার্টের স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ করার জন্য, বিশেষজ্ঞরা সর্বদা একটি লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করার পরামর্শ দেন যা আমাদের শরীরে উপস্থিত কোলেস্টেরলের ভাল, খারাপ বা উদ্বেগজনক মাত্রাকে দেখায়। বেঙ্গালুরুর ডায়াবেটোলজিস্ট অশ্বিতা শ্রুতি দাস ব্যাখ্যা করেন, “LDL-এর তুলনায় বেশি মাত্রায় HDL থাকা হার্টের জন্য সবসময়ই উপকারী।” তিনি ব্যাখ্যা করেন ৪০ থেকে ৬০ mg/dl -এর মধ্যে থাকে HDL -এর লেভেল সাধারণত ইঙ্গিত দেয় যে আমাদের হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভাল কোলেস্টেরলের দ্বারা ভালভাবে বজায় রাখা হচ্ছে।
ডায়াবেটোলজিস্টের মতে, HDL এক সহায়ক পরিবহনকারীর মতো যা খারাপ কোলেস্টেরলকে লিভারে ভাঙার জন্য বয়ে নিয়ে আসে। “এই স্থানান্তরটি ধমনীতে প্ল্যাক গঠনে বাধা দেয় যা অন্যথায় বন্ধ হওয়া, সংকীর্ণ হওয়া বা শক্ত হওয়ার কারণে ক্ষতির কারণ হতে পারে,” তিনি ব্যাখ্যা করেন। ধমনীতে ক্ষতি হওয়া বা ব্লকেজ হওয়ার কারণে শরীরে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
HDL এছাড়াও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উপকারী গুণ নিয়ে গঠিত যা LDL-কে অক্সিডাইজ করা থেকে রক্ষা করে এবং শরীরের ক্ষতি করে। “এইভাবে, অক্সিডাইজেশন যা একটি প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে যার ফলে ধমনী শক্ত হয়ে যেতে পারে তা প্রতিরোধ করা হয়,” ডাঃ দাস ব্যাখ্যা করেন।
HDL-এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এর অ্যান্টিথ্রোম্বোটিক বৈশিষ্ট্য যা রক্তের প্রবাহকে বজায় রাখতে উৎসাহিত করে এবং এথেরোস্ক্লেরোসিস বা প্ল্যাক গঠনের প্রক্রিয়াকে ধীর করে।
স্বাস্থ্যকর খাবার খান, নিয়মিত ব্যায়াম করুন
তাহলে, LDL একবার লিভারে পৌঁছলে কী হয়? ক্লিনিকাল নিউট্রিশনিস্ট ইশি খোসলা ব্যাখ্যা করেন যে একবার LDL লিভারে পৌঁছালে তা হয় VLDL-তে পরিবর্তিত হয় নয়তো বা বাইল অ্যাসিড বা পিত্ত অম্লে রূপান্তরিত হয় যা অন্ত্রে পিত্ত রসের সাথে নিঃসৃত হয়। খোসলার মতে, কোলেস্টেরল লিভারে সংশ্লেষিত হয় এবং লিভার প্রতিদিন প্রায় ১,৫০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল তৈরি করে। “এই পরিমাণটি ইতিমধ্যেই এক দিনের ডায়েটে যা থাকে তার চেয়ে অনেক বেশি,” তিনি ব্যাখ্যা করেন। খোসলা বলেন, যদিও খাদ্যে কোলেস্টেরলের পরিমাণ প্রতিটি ব্যক্তি বিশেষে এবং প্রতি দিন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়, তাই সঠিক পরিমাণে ‘ভাল কোলেস্টেরল’ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
“স্বাস্থ্যকর খাবারের পাশাপাশি ভাল কোলেস্টেরল পেতে আপনাকে শারীরিক কার্যকলাপ করতে হবে এবং অতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপান থেকে দূরে থাকতে হবে,” ডঃ দাস ব্যাখ্যা করেন।
বেঙ্গালুরুর অবন্তিকা মিশ্র তার LDL-কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং HDL-এর স্বাস্থ্যকর মাত্রা বজায় রাখার জন্য সুষম খাদ্য খাওয়ার এবং ব্যায়াম করার প্রতিজ্ঞা করেন। “আমি বুঝতে পেরেছি যে LDL কখনই মিথ্যা বলে না কারণ যখনই আমি ভুল খাবার খেয়েছি বা জিমে যাওয়া এড়িয়ে গিয়েছি, আমার রক্ত পরীক্ষায় LDL -এর মাত্রা বেড়ে গেছে,” ৩৮ বছর বয়সী এই প্রযুক্তিবিদ বলেন৷ “কয়েক মাস আগে, সঠিক খাবার খাওয়ার পরিবর্তে, আমি বেশিরভাগ সন্ধ্যায় এবং কখনও কখনও দুপুরে খুব বেশি পরিমাণে ঘি চপচপে গাজরের হালুয়া স্ন্যাকস হিসাবে খেতাম। এবং আমার রিপোর্টে বেশি মাত্রার LDL দেখায়, “তিনি বলেন।
তখন থেকেই মিশ্র সময়মতো স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে শুরু করেন এবং একজন প্রশিক্ষকের অধীনে ব্যায়াম করতে শুরু করেন। “আমার সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলি দেখায় যে আমার LDL স্বাভাবিক সীমার মধ্যে ফিরে এসেছে, এবং আমি এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আশা করি, একই ডায়েট এবং ব্যায়ামের প্যাটার্ন অনুসরণ করব,” মিশ্র বলেন।
লক্ষ্য উচ্চ কিন্তু শর্ত প্রযোজ্য
ডাঃ দাস মনে করেন LDL-এর তুলনায় HDL-এর উচ্চ স্তর ভাল, HDL-এর অতিরিক্ত থাকা সবসময় হার্টের পক্ষে অনুকূল নাও হতে পারে, বিশেষ করে আপনার যদি নির্দিষ্ট অটোইমিউন কন্ডিশন থাকে। “কিছু গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে আপনার যদি অটোইমিউন কন্ডিশন যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা ডায়াবেটিসের মতো মেটবলিক কন্ডিশন থাকে তবে আপনি হার্টের সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আপনার HDL-কেও প্রস্তাবিত মাত্রার মধ্যে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়, “তিনি সতর্ক করেন।
“এছাড়াও, আপনাকে যা মনে রাখতে হবে তা হল যে HDL শুধুমাত্র প্ল্যাক গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে আপনাকে সাহায্য করতে পারে যতক্ষণ না সেটি খুব ঘন হয়ে যায়, তবে যদি ধমনীগুলি ইতিমধ্যেই বুজে গিয়ে এবং সংকুচিত হয়ে থাকে তাহলে এটি আপনাকে সাহায্য করবে না,” তিনি আরও বলেন।
ডাঃ দাস আরও উল্লেখ করেন যে ভাল কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য, শর্করা এবং চর্বির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং থাইরয়েডের মাত্রার উপর নজর রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “সবসময় মনে রাখবেন যে, যখন আপনার শর্করার মাত্রা বেশি থাকে, তখন কোলেস্টেরলও বাড়তে থাকে। একইভাবে, যদি আপনার থাইরয়েড যদি ভালভাবে কাজ না করে তবে লিভার তার স্বাভাবিক মাত্রার কোলেস্টেরল তৈরি করতে পারে না এবং এইভাবে এটি (কোলেস্টেরল) বেড়ে যায়, “তিনি বলেন।
ভাল কোলেস্ট্রেল বাড়াতে যা খাবেন
ডাঃ সিং এর মতে, কাজুবাদাম বাদে সমস্ত শুকনো ফল HDL কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে ভাল কাজ করে। “আম, আঙ্গুর, অ্যাভোকাডোর মতো ফলমূল, সয়া প্রোডাক্ট, গ্রিন টি এবং সবুজ শাকসবজি HDL -এর মাত্রা বাড়াতে পারে এবং LDL -এর মাত্রা কমাতে পারে,” তিনি ব্যাখ্যা করেন। ভাল কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ানোর জন্য, ডাঃ সিং নিয়মিত ব্যায়াম করার, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার এবং পরিমিত অ্যালকোহল পান করারও পরামর্শ দেন।
বেঙ্গালুরুর ৩৬০ ডিগ্রি নিউট্রিকেয়ারের ডায়েটিশিয়ান দীপলেখা ব্যানার্জির মতে, HDL বাড়ানোর জন্য আপনার ডায়েটে চর্বিহীন মাংস, অঙ্গের মাংস, বাদাম ও শাকসবজি ছাড়াও উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের উৎস এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল যোগ করা উচিত।
“৩০ মিলি থেকে ৬০ মিলি রেড ওয়াইন খাওয়া ভাল কারণ এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ এবং অক্সিডাইজড LDL কমাতে পারে,” ডঃ দাস ব্যাখ্যা করেন৷