
ঠিক যে সময়ে কলকাতা ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে, সেই সময় এই শহরটি সাত দিনের জ্বর হিসাবে পরিচিত একটি জ্বরে ভুগতে শুরু করেছে। স্থানীয় এলাকার ছড়িয়ে পড়তে থাকা এমন এক ধরণের ভাইরাল ইনফেকশন যাতে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে জ্বর থাকার সাথে শরীরে গুরুতর রকমের ব্যথা এবং ক্লান্তি থাকার একটি ধরণকে লক্ষ্য করা যায়।
“যদিও সাধারণ ভাইরাল ফ্লু ৩ দিনের বেশি থাকে না, তবে এই সংক্রমণটি (যাকে সাত দিনের জ্বর বলা হয়) সাধারণত প্রায় ৭ দিন ধরে থাকে, যা ডেঙ্গুর সাথে এটির সাদৃশ্য বা মিলকে আরও বাড়িয়ে তোলে,” কলকাতার মেডিকা ইনস্টিটিউট অফ ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড ডিরেক্টর এণ্ড কোঅর্ডিনেটর, ডাঃ তন্ময় ব্যানার্জি, ব্যাখ্যা করেন।
মণিপাল হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশ্যালিস্ট ডাঃ দীপঙ্কর সরকার অবশ্য আরও বলেন যে অন্য কোনোও ভাইরাল ইনফেকশনের মতো সাত দিনের জ্বর বলে কিছু নেই। “বেশিরভাগ ভাইরাল ফিভার নিজের থেকেই কমে যায় এবং লক্ষণমূলক চিকিৎসার দ্বারা ৭ দিনের মধ্যে সেরে যায়,” ডাঃ সরকার বলেন
কলকাতার একজন গৃহিনী শামলি মিত্র (৭১), যিনি এই সংক্রমণ থেকে সেরে উঠছেন, তিনি স্মরণ করে বলেন, “এক রাতে আমি অনুভব করলাম জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। আমি AC বা ফ্যান চালু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, আমার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ছিল না।” মিত্রার ক্ষেত্রে, এটা শুরু হয়েছিল দারুন মাথাব্যথা, গাঁটে গাঁটে ব্যথা এবং ক্ষুধামান্দ্য দিয়ে। “জ্বর এত বেশি ছিল যে মনে হচ্ছিল আমি পুড়ে যাচ্ছি। যা প্রথম দিন ৯৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে, পরের দিনে ১০৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়,” মিত্র আরও বলেন যে তিনি তখনও পর্যন্ত এতটা ক্লান্তি অনুভব করেননি।
“অসুস্থ হওয়া থেকে সেরে ওঠার যে সময়কাল তার উপর ভিত্তি করে স্থানীয় লোকেদের দ্বারা রোগটির ‘সেভেন-ডে-ফিভার বা সাত দিনের জ্বর’ নামকরণ করা হতে পারে,” বলে ডঃ ব্যানার্জি সন্দেহ করেন। এটি একটি সাধারণ বর্ষাকালীন সংক্রমণ, ডাক্তাররা আরও বলেন।
সাত দিনের জ্বর: লক্ষণগুলি কী ভাইরাল ফিভারের মতোই?
সাত দিনের জ্বরের লক্ষণগুলি ভাইরাল ফিভারের মতোই, তবে এতে সেরে ওঠার ক্ষেত্রে প্রচুর সময় লাগে এবং শরীরে প্রচুর ক্লান্তি দেখা দেয়, বিশেষজ্ঞরা বলেন।
ডাঃ ব্যানার্জি যিনি সাত দিনের জ্বরকে ক্যালকাটা ফিভারের সাথে তুলনা করেন, তিনি ব্যাখ্যা করেন, “জ্বর বাড়ার পাশাপাশি, শরীরে দারুন ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, ক্ষুধামান্দ্য, অতিরিক্ত ক্লান্তি, অলসতা হল সাত দিনের জ্বরের বিশিষ্ট লক্ষণ।”
“কিছু লোকের মধ্যে, এটি নিম্ন রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট এবং মাথা ঘোরার কারণ হতে পারে,” ডঃ ব্যানার্জি আরও বলেন।
চিকিৎসকরা আরও বলেন যে সাত দিনের জ্বরটি ‘ক্যালকাটা ফিভার’-এর মতো, একটি ভাইরাল ফিভার যা অনেক দিন ধরে থাকে।
সাত দিনের জ্বর সত্যিই কি দুশ্চিন্তার কারণ?
“এই জ্বর, যদিও কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নয়, তবে এটি একটি ডায়াগনস্টিক ডিলেমা বা রোগনির্ণয় সম্পর্কিত দ্বন্দ এবং এই ভাইরাল জ্বরের সঠিক প্যাথলজি এখনও অজানা,” বলেন ডঃ ব্যানার্জি৷
কলকাতার অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটালের জেনারেল ফিজিশিয়ান,ডাঃ জয়ন্ত শর্মা, আরও বলেন, “কলকাতা বর্ষাকালে বিভিন্ন ধরণের ভাইরাস ইনফেকশন হওয়ার ক্ষেত্রে এক হটস্পট। এই বছর ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, রোটাভাইরাস, এন্টারোভাইরাস এবং কিছু বিরল প্রজাতির ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ বেড়েছে।”
চিকিৎসকরা আরও বলেন যে যাদের অন্তর্নিহিত ফুসফুসের রোগ যেমন ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ আছে এবং যাদের হাঁপানি আছে তাদেরকে অবশ্যই ভাইরাল ফ্লুয়ের মরশুমে সতর্ক থাকতে হবে।
ডাঃ শর্মা পরামর্শ দেন সাত দিনের জ্বর বিপজ্জনক নয়, তবে সবাইকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে কারণ।
- এটি এক বা একাধিক প্রভাব বিস্তারকারী ভাইরাসের সংমিশ্রণের কারণে হতে পারে।
- এটিকে দীর্ঘদিন ধরে অত্যধিক মাত্রায় জ্বর (১০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত) হওয়ার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
- এটি হওয়ার ফলে কেউ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়তে পারে এবং মাথা ঘুরতে পারে
এটির থেকে সেরে উঠতে কমপক্ষে ২-৩ সপ্তাহ সময় লাগে।
কারা ঝুঁকিতে আছে?
“যাদের দুর্বল ইমিউন সিস্টেম আছে যেমন ১০ বছরের কম বয়সী শিশু, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তি, গর্ভবতী মহিলা এবং যাদের ইমিউনোকম্প্রোমাইজড কন্ডিশন আছে, যেমন ডায়াবেটিস, কিডনি বা লিভারের রোগ আছে, ফুসফুসের সংক্রমণ আছে তাদের অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে,” ডঃ শর্মা সতর্ক করেন।
কলকাতা কেন হটস্পট?
ডাঃ সরকার আরও বলেন যে বেশিরভাগ ভাইরাল ইনফেকশনই মরশুমি হয়, বর্ষাকালে যেগুলির প্রকোপ বেশি থাকে।
ডাঃ ব্যানার্জী বলেন, “এই বছর কলকাতায় যে সাত দিনের জ্বর ছড়িয়ে পড়ছে তার সাথে বিগত কয়েক বছরে কলকাতাকে প্রভাবিতকারী ক্যালকাটা ফিভারের খুব বেশি রকমের মিল আছে।”
চিকিৎসা
৭২ ঘন্টা ধরে যদি কারুর অত্যধিক মাত্রায় জ্বর হয়, তবে তাকে অবিলম্বে ডাক্তার দেখাতে হবে, ডাঃ শর্মা পরামর্শ দেন। চিকিৎসা অবশ্যই ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা হওয়ার সম্ভাবনাকে বাতিল করবে, ডাঃ শর্মা বলেন। একইভাবে মিত্রার ক্ষেত্রে, রক্ত পরীক্ষা তার ডেঙ্গু, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা হওয়ার সংক্রমণকে বাতিল করেছিল। তাই ডাক্তাররা এটাকে সাত দিনের জ্বর বলে ধরেন। মিত্রা, অন্যান্য অনেকের মতো, বাড়িতে থেকেই সাত দিনের জ্বর থেকে সেরে উঠছেন। কিন্তু, যখন ক্ষুধামান্দ্য, বমি বমি ভাব এবং মাথা ঘোরার মতো উপসর্গ দেখা দেয়, তখন বিশেষজ্ঞরা অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন।
চিকিৎসা প্রায়শই লক্ষণমূলক হয়, ডঃ সরকার ব্যাখ্যা করেন। তিনি আরও বলেন, “যদি শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়, তবে প্রচুর তরল পদার্থ পান করে নিজেকে রিহাইড্রেট করুন, যা রোগীকে সেরে উঠতে সহায়তা করে।”
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
যেকোনো ধরণের ভাইরাল ইনফেকশন ছোঁয়াচে হয়। তাই, ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া বা অন্য কোনো ধরনের সংক্রমণ রোধে সামাজিক সমাবেশ এড়িয়ে চলা, মাস্ক পরা, বাড়িতে রান্না করা গরম খাবার খাওয়া, পরিষ্কার জল পান করা, হাত পরস্কার রাখার জন্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা এবং রাস্তার খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলার মাধ্যমে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, ডঃ শর্মা পরামর্শ দেন।
সারসংক্ষেপ
- সাত দিনের জ্বর, এমন এক ধরণের ভাইরাল ফিভার, বর্ষাকালে হওয়া সাধারণ সংক্রমণ।
- ৭ দিনের বেশি জ্বর থাকা, শরীরে দারুন ব্যাথা ও মাথা ব্যথা হওয়া এবং অপরিসীম ক্লান্তি থাকা এটির প্রধান লক্ষণ।
- ৭২ ঘন্টা ধরে যদি কারুর অত্যধিক জ্বর থাকে তবে তাকে অবিলম্বে ডাক্তার দেখাতে হবে।
- জ্বরটি যদিও বিপজ্জনক নয়, তবুও অবিলম্বে চিকিৎসা শুরু না হলে তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে।