দুঃসাহসিক সব কাজকম্ম করতেই বড্ড ভালবাসতেন তিনি। প্যারাগ্লাইডিং থেকে স্কুবা ডাইভিং পর্যন্ত বাদ যায়নি কিছুই। কলকাতার 50 বছরের ব্যবসায়ী অরণ্য নাগ এভাবেই সুখে জীবনযাপন করছিলেন। কিন্তু গত দেড় দশকে অরণ্য নাগের শরীর তাঁর দুঃসাহসিক জীবনের পথে অন্যতম মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
2009 সালে অরণ্য বাবুর শরীরের ধরা পড়ে উচ্চ রক্তচাপ। তার জন্য তাঁকে ওষুধও খেতে হয়। ঠিক পাঁচ বছর পরেই তিনি চলে আসেন বেঙ্গালুরুতে। সেখানে এসে আবার আর এক সমস্যা। তাঁর মাইগ্রেন ধরা পড়ে এবং 2015 পর্যন্ত ওষুধ চলতে থাকে। তারপর একদিন প্রচণ্ড বমি শুরু হয় তাঁর। অনর্গল বমি করতেই থাকেন এবং শেষমেশ তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি করা মাত্রই আর এক কঠিন রোগ ধরা পড়ে। ডাক্তাররা জানান, অরণ্য নাগ ক্রনিক কিডনি ডিসিজ়ে (CKD) আক্রান্ত, যার স্টেজ 4-এ ছিলেন তিনি। এটি এমনই একটি ভয়ঙ্কর অবস্থা, যেখানে কিডনি ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রক্ত সঠিক ভাবে ফিল্টারও করে না।
তাঁর কথায়, “দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা বমি পর্বের পরে 2015 সালেই ডাক্তাররা আমাকে জানিয়েছিল যে, আমার ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা অনেক বেশি ছিল এবং আমাকে ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, সঙ্গে কঠোর ডায়েটও মেনে চলতে বলা হয়েছিল।”
2017 সাল পর্যন্ত অরণ্য নাগ ডায়ালিসিস ছাড়াই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেই পরিস্থিতি বেগতিক হতে থাকে। অবস্থা এতটাই খারাপ হতে থাকে যে, শেষ পর্যন্ত তাঁকে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয়।
ক্রনিক কিডনি ডিসিজ়
“ক্রনিক কিডনি ডিসিজ় বা CKD হল একপ্রকার সাইলেন্ট কিলার। এর লক্ষণগুলি একমাত্র অ্যাডভান্সড্ স্টেজেই দেখা যায়”, বলছেন ব্যাঙ্গালোরের ওল্ড এয়ারপোর্ট রোডের মনিপাল হসপিটালের এইচওডি এবং কনসালটন্ট নেফ্রোলজি, ট্রান্সপ্লান্ট চিকিৎসক ডাঃ বিশ্বনাথ এস। তিনিই অরণ্য নাগের চিকিৎসা করেছিলেন। তাঁর কথায়, “কোনও পারিবারিক ইতিহাস না থাকা সত্ত্বেও নাগের কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে, যা তাঁকে কিডনির ব্যর্থতার দিকে পরিচালিত করে।”
অরণ্য নাগের স্ত্রী শতাব্দী প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না কী করা যায়। তিনি বললেন, “ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন, CKD-এর কোনও নিরাময় নেই এবং সেই কারণেই ঈশ্বর আমাদের দুটি কিডনি দিয়েছেন। যাঁদের একটা কিডনির প্রয়োজন আছে, তাঁদের যাতে আমরা দান করতে পারি। ডাক্তারের কথা আমাদের খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে চলেছে, তারও কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলাম আমরা।”
প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন
অরণ্যের যে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন রয়েছে, তা জানতে পারার পরে শতাব্দী ও তাঁর মা রুনু রায় দুজনেই একটি দান করার প্রস্তাব দেন। শেষমেশ তাঁদের পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, রুনু রায়ই তাঁর জামাইকে কিডনি দান করবেন।
শতাব্দীর কথায়, “তখন আমার মায়ের বয়স ছিল 60 বছর। তিনি আমাদের জানিয়েছিলেন, সুস্থ থাকাকালীনই অরণ্যকে কিডনি দান করতে চান। ভবিষ্যতে তিনি তা আর করতে পারতেন না।”
নাগ দম্পতি এবং শতাব্দীর মা ইতিমধ্যেই সক্রিয় রক্তদাতা ছিলেন এবং তাঁরা বেশ কয়েকটি রক্তদান শিবিরেও যোগদান করেছিলেন। শতাব্দী বললেন, “আমরা সবাই আমাদের সমস্ত অঙ্গ দানের অঙ্গীকার করেছি।”
অরণ্য নাগ জানালেন, 2017 সালে কিডনি প্রতিস্থাপন যেন তাঁর জীবন বদলে দিয়েছিল। তাঁর কথায়, “আমি আরও উদ্যমী বোধ করতে শুরু করি এবং নিজেকে আগের থেকে অনেক বেশি সুস্থও মনে হচ্ছিল।” আরও যোগ করে তিনি বললেন, “আমার যাবতীয় কাজকর্ম পুনরায় শুরু করে দিলাম। শুধু তাই নয়। টেবিল টেনিস খেলাও শুরু করি এবং সাইক্লোথনেও অংশগ্রহণ করি।”
নাগের শরীরে তিনটি কিডনি রয়েছে। এদের মধ্যে নতুন অর্থাৎ যেটি দান করা হয়েছিল, সেটিই কাজ করছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের সময় নতুন বাদ দিয়ে বাকি দুটি অক্ষত থাকে এবং নতুন কিডনিটি পেটের অংশে স্থাপন করা হয়। শরীরের রক্ত ফিল্টার করার কাজটি করে নতুন কিডনি। আর বাকি দুটিও ন্যূনতম কিছু কাজ করে।
এমতাবস্থায়, পরিবারে যখন এমন বিরাট ঝড় উঠেছিল, তখন অরণ্যের স্ত্রী শতাব্দী গাড়ি চালানো শিখে নিয়েছেন। স্বামীকে নিয়ে তিনি এখন যে কোনও জায়গায় যেতে পারেন। ভবিষ্যতে যদি আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, সেই অবস্থা থেকে পরিবারকে রক্ষা করতে তিনি এখনই নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছেন।
দ্বিতীয় কিডনি প্রতিস্থাপন
2022 সালের জানুয়ারি মাসে আর এক বিপদে পড়েন অরণ্য নাগ। সে বছর কোভিড আক্রান্ত হন তিনি। যার ফলে তাঁর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হয়। সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার পর তাঁর ক্রিয়েটিনিনের মাত্রাও বাড়তে থাকে। এমনকি, ডায়ালাইসিসও কাজে আসেনি। সেই কারণেই তাঁর আর একটি দ্বিতীয় কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়েছিল।
তিনি বললেন, “সেই দিনটা আমি কখনও ভুলব না, যখন নিঃশ্বাস নিতে আমাকে রীতিমতো ছটফট করতে হচ্ছিল। আমার স্ত্রী পিক আওয়ারে গাড়ি চালিয়ে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।” অরণ্য আরও যোগ করে বললেন, “আমার ফুসফুসে জল জমতে শুরু করেছিল এবং আমাকে বলা হয়েছিল, তিনটে কিডনিই অকেজো হয়ে গিয়েছে।”
ফের একটা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়ে যায়। আর এবারে অরণ্যের স্ত্রী শতাব্দী তাঁকে কিডনি ডোনেট করেন। তারপরে 2023 সালের মার্চে সার্জারি হয় তাঁর, যার ঠিক একদিন পরেই অরণ্য এবং শতাব্দীর বিবাহবার্ষিকী ছিল।
পরপর দু’বার কিডনি প্রতিস্থাপনের পরে অরণ্য নাগের শরীরে এই মুহূর্তে মোট চারটি কিডনি রয়েছে। তিনি অত্যন্ত কঠোর একটি ডায়েট মেনে চলেন এবং নিজেকে সারাদিন হাইড্রেটেড রাখতে ছয় থেকে সাত লিটার জল পান করেন।
প্রতিস্থাপন পরবর্তী জীবন
দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারের এক মাসও হয়নি। এর মধ্যেই বিদেশ ভ্রমণ শুরু করে দেন অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী এই দম্পতি। শতাব্দী বললেন, “আমরা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করি। প্যারাগ্লাইডিং, স্নরকেলিং, স্কুবা ডাইভিং-সহ আরও অনেক কিছুই করতে গিয়েছিলাম আমরা। একজন ডোনর হিসেবে আমি মোটেও অন্যরকম মনে করি না। আমি আগেও যেমন ছিলাম, এখনও ঠিক তেমনই আছি। অরণ্যকেও আমি বলি, আগের মতোই জীবনযাপন করতে।”
এত কিছুর পরেও অরণ্য নাগ জীবনটাকে অত্যন্ত ইতিবাচক ভাবে দেখতেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, “তিনি সবসময়ই বলেন যে, তাঁর জীবনে কোনও চ্যালেঞ্জ নেই। জীবন যে ভাবে তাঁর কাছে আসে, সেই ভাবেই তিনি সেটাকে নেন, এগিয়েও চলেন এবং নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেন।”
কলেজে পড়াশোনা করার সময় থেকেই একে অপরকে চেনেন অরণ্য এবং শতাব্দী। “সেই কলেজ থেকেই ও আমার প্রিয়বন্ধু,” বললেন শতাব্দী। সঙ্গে আরও যোগ করে বললেন, “আমরা কখনও একে অপরকে প্রপোজ় করিনি। আমরা একে অপরকে খুব ভাল করে বুঝি। কলেজ থেকে বেরোনোর পরেই আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। ওর এই পরিস্থিতির কথা যখন আমি জানতে পারি, খালি এইটুকু বিশ্বাস ছিল যে, দুজনে একসঙ্গে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠব।”