দাঁত এবং মাড়ির স্বাস্থ্য খারাপ হলে সংক্রামক এন্ডোকার্ডাইটিস হতে পারে অর্থাৎ হার্ট ভালভের আস্তরণের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ।
দাঁত এবং মাড়ির স্বাস্থ্যের সাথে হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। দাঁতের স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করলে শুধু নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ হয় এমন নয়। দাঁতের সমস্যা হৃদযন্ত্র এমনকি হৃদপিণ্ডের ধমনীর কার্যকারিতাকেও প্রভাবিত করতে পারে। ডেন্টিস্ট এবং কার্ডিওলজিস্টরা সতর্ক করে দেন যে দাঁত ও মাড়ির যত্ন না নিলে এগুলির ক্ষতি ছাড়াও ইনফএক্টিভ এন্ডোকার্ডাইটিস নামে একটি ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত সংক্রমণ হতে পারে। এটি ধমনীর প্রদাহ এবং হৃদপিণ্ডের ভালভের সংক্রমণের কারণ হতে পারে যার চিকিৎসা করা না হলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে মুখ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি স্বাস্থ্যকর ডায়েট এবং ওয়ার্কআউটের মতোই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর সাথে হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা জড়িয়ে রয়েছে।
নিউ দিল্লির বিএলকে–ম্যাক্স সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের কার্ডিওলজির সিনিয়র ডিরেক্টর ডাঃ নীরজ ভাল্লা জানান যে দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া এবং হার্ট অ্যাটাক বা একিউট কার্ডিয়াক সিন্ড্রোমের (যখন হৃৎপিণ্ডে হঠাৎ করে রক্ত প্রবাহ কমে যায়) মতন গুরুতর হৃদজনিত রোগ, এই দুইয়ের মধ্যেই সম্পর্ক রয়েছে।
ইনফএক্টিভ এন্ডোকার্ডাইটিস কী
বিজ্ঞান জার্নাল সার্কুলেশন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধ-এ একটি বড় এবং সম্ভাবনাময় গবেষণাকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যেখানে মুখের স্বাস্থ্য এবং মাড়ির রোগের কিছু সূচক এবং ইনফএক্টিভ এন্ডোকার্ডাইটিস(IE)-সম্পর্কিত প্রজাতি থেকে ব্যাকটেরেমিয়ার ঘটনাগুলির মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। IE হৃৎপিণ্ডের ভালভের আস্তরণের একটি ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত সংক্রমণ। এই নিবন্ধে বলা হয়েছে যে দাঁত ও মাড়ির অপরিচ্ছন্নতার ফলে জিনজিভাইটিস হয় যার থেকে পিরিয়ডোনটাইটিস হতে পারে এবং সম্ভবত এই দুটি পেরিওডন্টাল রোগ IE কমিউনিটিভুক্ত। বর্তমানকালের গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে মুখের খারাপ স্বাস্থ্যবিধি এবং পেরিওডন্টাল রোগ এবং নট ডেন্টাল অফিস প্রসিডিউর (প্রতিরক্ষামূলক দাঁতের পদ্ধতি এবং প্রোটোকল)IE থেকে প্রচন্ড বেশি পরিমাণে হয় যা মুখগহ্বর থেকে মূলত ছড়ায়।
ডাঃ দিব্যা মেরিনা ফার্নান্ডেস, পরামর্শদাতা, হার্ট ফেইলিউর স্পেশ্যালিস্ট এবং ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, অ্যাস্টার আরভি হাসপাতাল, ইনফএক্টিভ এন্ডোকার্ডাইটিসের উপর আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেন, “এটি ঘটে যখন ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য জীবাণু রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে এবং একজন ব্যক্তির হার্টে পৌঁছায়। এই জীবাণুগুলি তখন ক্ষতিগ্রস্ত হার্টের ভালভ বা টিস্যু/কলাতে আটকে যায় এবং সংক্রমণ ও প্রদাহ সৃষ্টি করে।”
স্টারপার্লজ-এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা বলছে, ইনফেক্সাস এন্ডোকার্ডাইটিস হল এন্ডোকার্ডিয়ামের প্রদাহ এবং এটি প্রাথমিকভাবে ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত একটি রোগ এবং এটির বিস্তার অনেকখানি। দ্রুত শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা ছাড়া অসংখ্য ইন্ট্রাকার্ডিয়াক এবং সুদূরপ্রসারী এক্সট্রাকার্ডিয়াক জটিলতা তৈরি হতে পারে। সুতরাং একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষাসহ যত্নশীল মূল্যায়ন রোগ নির্ধারণে সাহায্য করতে পারে এবং মৃত্যুহার এবং অসুস্থতা সীমিত করতে পারে।
ফার্নান্ডেস বলেন, “দাঁত ও মাড়ির অপরিচ্ছন্নতা, দাঁত ব্রাশ করার সময় মাড়িতে লাগা সামান্য আঘাত এবং কখনও–কখনও দাঁতের কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি ইনফএক্টিভ এন্ডোকার্ডাইটিসের কয়েকটি মুখ্য কারণ।” বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন যে সকলের এই বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত এবং কোনো ব্যক্তি যদি চিবানোর সময় এবং গিলতে ব্যথা অনুভব করেন্, যদি মাড়ি ফুলে যায় বা রক্তপাত হয় অথবা জ্বর, গালের হাড়ে ব্যথা, সর্দি, গলা ব্যথা, নাক বন্ধ হওয়া, মাথাব্যথা এবং পেশীতে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ডাঃ ভাল্লা যোগ করেন যে IE বিভিন্ন কারণে হতে পারে – যেমন মুখের গহ্বরে দীর্ঘস্থায়ী বা তীব্র প্রদাহ যেমন পাইরিয়া, জিনজিভাইটিস বা মাড়ির দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনক অবস্থা যা এথেরোস্ক্লেরোটিক প্রক্রিয়াগুলিকে প্রভাবিত করে (যখন প্লাকের কারণে ধমনী স্থূল এবং শক্ত হয়ে যায়)। এর ফলে ধমনীতে প্রদাহ হতে পারে যা হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ।
আরেকটি সমস্যা হল বিকৃত বা প্রসথেটিক (কৃত্রিম) কার্ডিয়াক ভালভ্ (আর্টিফিশিয়াল কার্ডিয়াক ভালভ্) আছে সেরকম রোগীদের মুখগহ্বরের অপরিছন্নতা। ডঃ ভাল্লা বলেন, “বিশেষ করে যদি কোনো যন্ত্র দ্বারা চিকিত্সা করা হয় যেমন দাঁত তোলা বা কোনো অস্ত্রোপচার করা হয় তাহলে এটি ব্যাকটেরেমিয়া সৃষ্টি করে যাতে অনেক ব্যাকটেরিয়া রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে এবং যন্ত্রের কারণে সৃষ্ট আঘাতের ফলে ছড়িয়ে পড়ে।”
ডাঃ নীতু কামরা, হেড ডেন্টাল এবং ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি, বিএলকে–ম্যাক্স সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল, নিউ দিল্লি, বলেছেন যে পেরিওডোনটাইটিস একটি গুরুতর মাড়ির সংক্রমণ যা কেবল মাড়ির ক্ষতি করে না, এমনকি চোয়ালের হাড়ও নষ্ট করতে পারে।
সতর্কবার্তা
ডাঃ ভাল্লা বলেছেন যে ভালভ সার্জারি করার আগে লোকেদের সর্বদা একজন ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়ার এবং ইনফেক্টিভ এন্ডোকার্ডাইটিসের ঘটনা আটকাতে যে কোনও নষ্ট দাঁত তুলে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়। ডাঃ ভাল্লা বলেন, “যে রোগীদের ইনফেক্টিভ হার্ট ভালভ রয়েছে তাদের দাঁতের কোনো অস্ত্রোপচার অথবা অন্য কোনো অস্ত্রোপচারের আগে অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় যা রক্তে ব্যাকটেরিয়ার প্রবাহকে নষ্ট করতে পারে।”
এর অর্থ হল যে কোনও সংক্রামিত স্থানে, যেখানে অপারেশন করা হচ্ছে, তাঁর জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ দেওয়া হয়। এই ভালভ্গুলিতে কোনও সংক্রমণ যাতে না হয় সেজন্য অপারেশনের পরেও কয়েক ডোজ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
কাদের ঝুঁকি বেশী
ডাঃ কারমার মতে যাদের মুখের অপরিচ্ছন্নতার সমস্যা রয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই হার্টের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে পিরিয়ডোনটাইটিস (মাড়ির রোগ), ডায়াবেটিস এবং ইমিউনোকম্প্রোমাইজড রোগীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরো বেশী।
ডাঃ ভাল্লা বলেন যে একবার ইনফেক্টিভ এন্ডোকার্ডাইটিস দেখা দিলে তা গুরুতর এবং প্রাণঘাতী পরিস্থিতি হয়ে উঠে। বিশেষ করে যাদের হৃদপিণ্ডে যান্ত্রিক বা কৃত্রিম অংশ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এটি আরও ক্ষতিকর।
ইনফেক্টিভ এন্ডোকার্ডাইটিসের চিকিৎসা
ডাঃ ফার্নান্ডেসের মতে চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে কয়েক সপ্তাহের অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য ওষুধ এবং কখনও–কখনও অস্ত্রোপচার। তিনি সতর্ক করেছেন, “দ্রুত এবং অত্যন্ত কার্যকর চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক লোক বেঁচে যায়। চিকিৎসা না করলে এন্ডোকার্ডাইটিস মারাত্মক হতে পারে।”
ডাঃ কামরার মতে দাঁতের চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে আশেপাশের হাড়ের ক্ষতি রোধ করার জন্য দাঁতের চারপাশের পকেট পেশাদারভাবে পরিষ্কার করা। তিনি বলেন, “গুরুতর কেসের ক্ষেত্রে ফ্ল্যাপ সার্জারির (একটি পুনর্গঠনমূলক ডেন্টাল সার্জারি) প্রয়োজন হতে পারে।”
ডাঃ ভাল্লা বিশ্বাস করেন যে দাঁত ও মাড়ির সুস্বাস্থ্য এবং সময়মতো ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়ার মাধ্যমে এই সমস্যা প্রতিরোধ করা যায় এবং আগে থেকে এড়ানো যায়। তিনি বলেন, “আপনার যদি আগের থেকে কোনো সমস্যা থাকে তাহলে কী–কী সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত তা জানা গুরুত্বপূর্ণ।”
ইনফেক্টিভ এন্ডোকার্ডাইটিসের লক্ষণ
ডাঃ ফার্নান্ডেস বলেছেন যে একজন ব্যক্তির যদি ব্যথা ছাড়াও ক্রমাগত দাঁতে বা মাড়িতে সংক্রমণ, প্রদাহ এবং ১০০° ফারেনহাইটের উপরে জ্বর থাকে তবে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত। তাঁর মতে, “কখনও কখনও আপনি অনুভব করতে পারবেন যে ঘা’গুলি সারছে না এবং আপনার মুখ বা জিভে সাদা সাদা ছোপ। আবার কিছু মানুষের গা-গোলানো ভাব, বমি বা ডায়রিয়া হতে পারে। এছাড়াও শ্বাসকষ্ট এবং ক্ষুধা কমে যাওয়া এবং ফলস্বরূপ ওজন কমে যেতে পারে।
এই লক্ষণগুলির দিকেও খেয়াল রাখা উচিত
- পেশী এবং জয়েন্ট/ অস্থিসন্ধিতে ব্যথা
- ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়ি
- ভিতরে ভিতরে রক্তপাত
- ঢোক গেলার সময় গলা ব্যথা বা অস্বস্তি
- মাথাব্যথা ও নাক বন্ধ
- ক্রমাগত সর্দি–কাশি
ডাঃ কামরার মতে মুখের সংক্রমণের উপসর্গসহ একজন ব্যক্তি নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ বা মুখে বিস্বাদ অনুভব করতে পারেন যা কখনই দূর হয় না । তিনি বলেন, “কিছু মানুষ চিবানোর সময় ব্যথা অনুভব করতে পারেন এবং মাড়ি লাল বা ফুলে যেতে পারে বা রক্তপাত হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে দাঁতগুলি সংবেদনশীল হয়ে যায় বা আলগা হয়ে যেতে পারে কারণ সংক্রামিত মাড়ি দাঁতকে সুরক্ষা প্রদান করতে পারে না।” এছাড়াও মাড়ি আর দাঁতের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ার ফলে মাড়ি পিছন দিকে সরে যায়।