অল্প বয়সে তো আর কেউ বুড়ো হয়ে যায় না! বার্ধক্য প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই আসে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর। কেউ যদি মনে করেন যে বুড়ো হবেন না, তাহলে চলবে না। জন্ম ও মৃত্যুর মতো বয়ঃপ্রাপ্তি, বার্ধক্যও প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। আর বয়স যে বাড়ছে, সর্বপ্রথম তার জানান দেয় আপনার চুল। কিন্তু এখন সত্যিই কি চুলে পাক ধরার বিষয়টা বয়স বাড়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত? ইদানিংকালে অনেককেই আমরা দেখতে পাই, যাঁদের অল্প বয়সেই চুল পেকে গিয়েছে। এমনকি, কিছু ক্ষেত্রে আবার এমনও দেখা যায় যে ছেলের বয়স 20 ছোঁয়নি, কিন্তু মাথায় একগাদা পাকা চুল। অকালপক্ক চুল, অকালপক্কতা বা অল্প বয়সেই চুল পেকে যায় যাঁদের, তাঁদের জীবনে হতাশা গ্রাস করে। মানসিক অবসাদে ভোগেন অনেকে। কেন হয় এমনটা, চুল পাকার স্বাভাবিক বয়সই বা কত, এই সব প্রশ্নের উত্তরই আমরা আজকে জেনে নেব।
কোন বয়সে চুল পাকা স্বাভাবিক?
সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। ঠিক তেমনই চুল পাকারও একটা নির্দিষ্ট বয়স রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চুল পাকার আদর্শ বয়স হল 30-35। এই সময় থেকে মাথায় দু’একটা চুল পাকলে তেমন কোনও সমস্যা নেই, বিষয়টাকে স্বাভাবিক হিসেবেই ধরা যেতে পারে। কিন্তু তার আগে পাকলেই তাকে ‘অকালপক্বতা’ হিসেবে ধরা হয়। কোন বয়স থেকে চুল পাকলে তাকে অকালপক্বতা ধরা হবে, তা নিয়ে 2019 সালের একটি গবেষণাপত্রে আলোচনা করেছেন বিজ্ঞানী ডি রিটা আংগ্রিনির নেতৃত্বাধীন গবেষণা দল। তাঁরা জানিয়েছেন, শ্বেতাঙ্গদের ক্ষেত্রে এই বয়সসীমা 20 ধরা হয়, এশিয়ানদের ক্ষেত্রে 25, আফ্রিকানদের ক্ষেত্রে তা 30। অর্থাৎ দেশ, মহাদেশ এবং জাতি নির্বিশেষে চুল পাকার বয়সসীমা পরিবর্তিত হতে পারে।
কিন্তু অল্প বয়সে চুল পেকে যাওয়ার কারণ কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অল্প বয়সে চুল পেকে যাওয়ার নেপথ্যে কিছু কারণ রয়েছে। বেশ কিছু গবেষণা ও সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, চুলের অকালপক্বতার অন্যতম প্রধান কারণ জেনেটিক বা বংশগত। অর্থাৎ পরিবারের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তাড়াতাড়ি চুল পেকে যাওয়ার ইতিহাস থাকলে এমনটা হতে পারে। যদিও তার ব্যতিক্রমও রয়েছে।
অন্যান্য কারণগুলি নিয়ে কলকাতার ফর্টিস হসপিটালের ত্বক বিশেষজ্ঞ ডাঃ মধুমিতা ভট্টাচার্য বললেন, “মানবদেহে বেশ কিছু হেয়ার ফলিকল আছে, যার মধ্যে থাকে মেলানিন নামের এক ধরনের পিগমেন্ট কোষ। এই কোষই চুলের রঙের নেপথ্য কারণ। এখন ফলিকল যদি পিগমেন্ট হারায়, তাহলে চুল সাদা হয়। এছাড়াও মানসিক চাপ, দূষণ ও খারাপ খাদ্যাভাসের মতো কারণগুলিও কম বয়সে চুল পাকার অন্যতম কারণ হতে পারে। মানসিক চাপে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে চুল পেকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আপনি যত বেশি চাপে থাকবেন, আপনার শরীর তত বেশি প্রভাবিত হবে। তাই বিশ্রাম নেওয়া, স্বাস্থ্যকর খাওয়া দাওয়া করা এবং যোগাসন বা প্রাণায়ামের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া খুব প্রয়োজন।”
মানসিক চাপ ও অবসাদ
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ডার্মাটোলজিস্ট ডাঃ সুকুমার জানার মতে, “যদি কেউ খুব চিন্তা, আর টেনশন করতে থাকেন, তাহলে কম বয়সেই তাঁর চুল পেকে যেতে পারে। এছাড়া কাজের চাপ থাকলেও অল্প বয়সে চুল পেকে যায়।” তাঁর পরামর্শ, “দুশ্চিন্তা থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে। অকারণ চিন্তা করলে চলবে না। মানসিক চাপ ও অবসাদ কাটানোর জন্য যা-যা করা জরুরি, তার সবই করতে হবে।”
ডাঃ সুকুমার জানা আরও বলেন, “যথাযথ ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফোলেট, ভিটামিন বি 12, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি-এর অভাবে অকালে চুল পেকে যায়। আবার, ভিটামিন সি জাতীয় খাবারের মধ্যে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট থাকে, যা ত্বক ও চুলের পুষ্টি যোগাতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি 12-এর অভাব দেখা দিলে, মাথায় দ্রুত হারে চুল পাকতে শুরু করে।” ভিটামিন বি 6, ভিটামিন ই-এর অভাব থাকলেও এই সমস্যা হতে পারে। ভিটামিন বি 12-এর ঘাটতি কমাতে দানা শস্য, দুগ্ধজাতীয় খাবার, ডিম খাওয়া যেতে পারে। তাতে কম বয়সে চুল পেকে যাওয়ার মত সমস্যা অনেকখানি কমতে পারে।
হরমোনের সমস্যা
হরমোনের সমস্যায় অকালে চুল পেকে যেতে পারে। আবার, থাইরয়েডের সমস্যা থাকলেও চুলের নানা সমস্যা তৈরি হয়। হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজমের সমস্যায় চুল অকালে পাকতে পারে। রক্তে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ কমে গেলে তখন হাইপোথাইরয়েডিজম দেখা দেয়। আবার, এই হরমোনের পরিমাণ বেড়ে গেলে তাকে হাইপারথাইরয়েডিজম বলে। তারুণ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে সেরেটনিন হরমোন অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু মানসিক অবসাদ, রক্তে সেরটনিন হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। তার ফলে ত্বক ও চুলের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সেরেটনিন হরমোন মানসিক উৎকর্ষের জন্যও কাজ করে। যত বেশি মন উৎফুল্ল থাকবে, যতবেশি ইতিবাচক চিন্তা বেশি করবেন, ততই সেরেটনিনের মাত্রা বেশি থাকে।
তাছাড়া অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করলে, চুলে অতিমাত্রায় ডাই ও রং ব্যবহার করলেও চুল অকালে পাকতে পারে। মাথায় রাখবেন, সব প্রসাধনী সবার জন্য উপযোগী নয়। ভেজাল খাবার ও পরিবেশ দূষণ চুল পাকার পিছনের আর এক কারণ। অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড, উচ্চমাত্রার প্রোটিন, অতিরিক্ত পরিমাণে সফট্ ড্রিঙ্ক, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং বয়স অনুযায়ী ওজন বেশি থাকলেও চুল কম বয়সে পাকতে পারে বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিছু অটোইমিউন ডিজ়িজ়ের কারণেও চুল সাদা হয়ে যায়। এই ধরনের রোগের মধ্যে ভিটিলিগো অন্যতম। কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি-সহ আরও বেশ কিছু ওষুধের প্রতিক্রিয়াতেও চুল পেকে যায়। এছাড়া, ধূমপান করলেও চুলের গোড়ার রক্তনালী শুকিয়ে যেতে পারে। ফলে, কম বয়সে চুল পেকে যায়।