ব্যায়াম প্রত্য়েকের জন্য়ই উপকারী। তবে মহিলাদের জন্য় তা আরও বিশেষ ভাবে উপকারী। কারণ, তাঁরা পিরিয়ড এবং মেনোপজ়ের কারণে সৃষ্ট হরমোনের ওঠানামা অনুভব করেন, যা তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। মুম্বইয়ের ডাঃ এল এইচ হিরানন্দানি হাসপাতালের গাইনোকোলজিস্ট ডাঃ চিতওয়ান দুবে ব্য়াখ্যা করে বলছেন, “মহিলাদের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, প্রতিদিন 30-40 মিনিট করে ধীরে হাঁটা, তাঁদের বয়স-সম্পর্কিত হরমোনজনিত সমস্যাগুলি যেমন, ইনসুলিন প্রতিরোধ, কর্টিসলের মাত্রা ভারসাম্য রাখা এবং হাড়ের স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ করার মতো একাধিক সমস্যাগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।”
বার্ধক্য পুরুষ এবং মহিলা নির্বিশেষে তাঁদের সার্কাডিয়ান ছন্দকে প্রভাবিত করে। ফলে, তাঁদের হরমোন সবথেকে বেশি পরিমাণে প্রভাবিত হয় এবং তার ফলে তাঁদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজ় এবং মাসিকের কারণে হরমোনের ওঠানামা করতে থাকে এবং এই প্রভাব বেশি করে দেখা যেতে থাকে। এখানেই ব্যায়াম মহিলাদের ক্ষেত্রে জিয়নকাঠির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত ব্যায়াম করলে মহিলাদের সার্কাডিয়ান ছন্দে বার্ধক্যের খারাপ প্রভাব খুব সহজেই মোকাবিলা করা যেতে পারে।
গৃহস্থালীর কাজ কি ব্যায়ামের মতোই সমান উপকারী?
না, ঘরের কাজ আর ব্যায়াম কখনই সমতুল্য হতে পারে না, স্পষ্ট করে জানালেন ডাঃ দুবে। তাঁর কথায়, “একটা ডিশওয়াশার ব্যবহার করে থালা-বাসন ধোয়া বা ভ্যাকুম ক্লিনারের মাধ্যমে ঘর পরিষ্কার করা আর সময় নিয়ে ব্যায়াম করা কখনই এক হতে পারে না।”
এ বিষয়ে ডাঃ দুবের ব্যাখ্যা, “যে কোনও ব্যায়াম অবশ্যই বেসাল মেটাবলিক রেট (BMR) বাড়াতে সাহায্য করে। সেই জায়গায় গৃহস্থালির সাধারণ কাজকর্ম সে ভাবে ফলপ্রসু হয় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত শারীরিক কসরত করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বললেন, ” সপ্তাহে 5 থেকে 6 দিন 40 মিনিট করে ব্যায়াম করাই BMR বাড়ানোর একমাত্র উপায়। আর তা যদি কেউ করতে পারেন, তাহলে অনাক্রম্যতা, হাড়ের স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির পাশাপাশি এবং খাবার থেকে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খনিজগুলি আরও ভাল ভাবে আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে।”
মহিলাদের জন্য সহজ ঘরোয়া ব্যায়াম
ব্যাঙ্গালোরের মেকোশা সমুদ্রের ফিটনেস এবং যোগব্যায়াম বিশেষজ্ঞ শিল্পা বীরাপ্পা বলছেন, মহিলারা ভাল শারীরিক এবং মানলিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব আরাম করেই বাড়িতে নানাবিধ ব্যায়াম করে নিতে পারেন।
প্রথম ব্যায়াম: বাটারফ্লাই পোজ় (বদ্ধ কোণাসন)
কীভাবে করবেন: পিঠ সোজা এবং বুক চওড়া করে আরামদায়ক অবস্থানে বসুন। হাঁটু একটু বাঁকান, যাতে পায়ের তলগুলি একসঙ্গে চাপা থাকে। এবার দুই পায়ের চারপাশে দুই হাত লক করুন। যৌনাঙ্গের কাছাকাছি হিল টানুন। আপনি যখন শ্বাস নিচ্ছেন এবং শ্বাস ছাড়ছেন, তখন প্রজাপতির মতো মেঝেতে আপনার থাই বা উরু ফ্ল্যাপ করতে থাকুন।
কত বার করবেন: কেউ দিনে 7-8 মিনিট পর্যন্ত এটি অনুশীলন করতে পারেন। তবে অল্প-অল্প করে শুরু করুন।
উপকারিতা: এটি একটি চমৎকার হিপ ওপেনার। এটি উরুর পেশিগুলিকেও সক্রিয় করে। এছাড়া পেলভিক অঞ্চলে নমনীয়তা বাড়ায় এবং প্রজনন ব্যবস্থাকে বাড়িয়ে তোলে। যাঁদের অনিয়মিত পিরিয়ড বা মাসিকের ক্র্যাম্প রয়েছে, তাঁদের জন্য এটি অত্যন্ত উপকারী।
সতর্কতা: এই সহজ ব্যায়ামের ক্ষেত্রে বয়সের কোনও বাধা নেই, যে কেউ এটি অনুশীলন করতে পারেন। গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা এড়াতে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বা ডিনারের পরে এটি করা এড়িয়ে চলুন।
দ্বিতীয় ব্যায়াম: বজ্রাসন (ডায়মন্ড পোজ়)
কীভাবে করবেন: হাঁটু গেড়ে বসুন এবং কাফ মাসলের মাঝে বসুন। পিঠটা সোজা রাখার চেষ্টা করুন। আপনার পা নিতম্বের কাছাকাছি রাখুন। হাঁটুর উপরে হাতের তালু রাখতে বাহু প্রসারিত করুন। এই অবস্থানে শ্বাস নিন এবং শ্বাস ছাড়ুন।
কত বার করবেন: কেউ এই অবস্থানে যতক্ষণ সম্ভব বসে থাকতে পারেন। তবে শুরুতে অল্প সময়ের জন্যই বসুন। খাওয়াদাওয়ার পরে এই ব্যায়াম করতে পারেন। যদি কেউ 20 মিনিট বা তার বেশি সময় ধরে বসে থাকতে পারেন, তাহলে এর থেকে ভাল ব্যায়াম আর কিছু নেই।
উপকারিতা: হজমের জন্য এই ব্যায়াম দুর্দান্ত। বজ্রাসন যেমন রক্ত সঞ্চালন উন্নত করতে পারে, তেমনই আবার মনকে শান্ত রাখতে পারে এবং পেলভিক ফ্লোর পেশিগুলিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
সতর্কতা: হাঁটুর ব্যথা বা অন্যান্য অন্ত্র-সম্পর্কিত সমস্যা ছাড়া সকল বয়সের মহিলাদের জন্যই এই ব্যায়াম নিরাপদ।
তৃতীয় ব্যায়াম: পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়ান
কীভাবে করবেন: শক্তভাবে মাটিতে দাঁড়ান। পা 12 ইঞ্চি দূরে অবস্থান করুন, পিঠ সোজা এবং বুক প্রশস্ত রাখুন। শ্বাস নিন, পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ান এবং পায়ের পিছনের দিকটা উপরের দিকে তুলুন। এই অবস্থায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শ্বাস নিতে থাকুন। শ্বাস ছাড়ুন এবং হিল নামিয়ে নিন। আবার করুন।
কত বার করবেন: একবার অন্তত 10 সেকেন্ড করে ধরে রাখতে হবে। আপনি চাইলে 10 থেকে 20 পর্যন্ত গণনা করতে পারেন। দিনে দু’বার- একবার সকালে এবং একবার সন্ধ্যায় করলে সবথেকে ভাল ফলাফল পেতে পারেন।
উপকারিতা: এই ব্যায়াম মহিলাদের মধ্যে ভেরিকোজ় শিরা এবং হাঁটুর ব্যথা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এটি তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যকর হয়, যাঁরা প্রায়শই রান্নাঘরে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন।
সতর্কতা: প্রত্যেক বয়সের মহিলাদের জন্য এই ব্যায়ামটি নিরাপদ। তবে, হাঁটুতে বা নিতম্বে আঘাত রয়েছে, তাঁদের এটি এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
চতুর্থ ব্যায়াম: শোল্ডার রোটেশন বা কাঁধ ঘোরাতে থাকুন
কীভাবে করবেন: সোজা হয়ে দাঁড়ান। মাটির সমান্তরালে চিবুকের অবস্থান বজায় রাখুন। শ্বাস নিন এবং শ্বাস ছাড়তে থাকুন। প্রতিটি হাত ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে সুইং করুন। চেয়ারে বসেও এই একই অনুশীলন করা যেতে পারে।
কত বার করবেন: এই ব্যায়ামটি বাহু এবং কাফ মাসলের নমনীয়তা বাড়ায়। হঠাৎ কাঁধ শক্ত হয়ে যাওয়া, স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি গুরুতর বিষয়গুলি প্রতিরোধ করে।
উপকারিতা: প্রথমে 5 বার করে ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং বিপরীত দিকে করতে থাকুন। ধীরে ধীরে সংখ্যাটা 10-এ নিয়ে আসুন।
সতর্কতা: কাঁধে ব্যাথা রয়েছে যাঁদের, তাঁদের এই ব্যায়ামটি এড়িয়ে চলাই ভাল। সকালে একবার এই ব্যায়ামটা অনুশীলন করা ভাল।
পঞ্চম ব্যায়াম: নেক রোটেশন বা ঘাড় ঘোরানো
কীভাবে করবেন: ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁটার দিকে, ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে, উপরে, নীচে এবং পাশের দিকে আপনার ঘাড় ঘোরান। মাটির সমান্তরালে চিবুকের অবস্থান বজায় রাখুন এবং অল্প-অল্প করে ঘাড় ঘোরান। এটি দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা অবস্থায় অনুশীলন করা যেতে পারে।
কত বার করবেন: সেরা ফলাফল পেতে সকালে উঠেই একবার এই ব্যায়াম অনুশীলন করুন।
উপকারিতা: এই ব্যায়াম ঘাড়ের পেশি শক্তিশালী করতে এবং নমনীয়তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
সতর্কতা: ভার্টিগো, ঘাড় বা কাঁধের সমস্যা ছাড়া সকলের জন্যই এই ব্যায়াম নিরাপদ।
ষষ্ঠ ব্যায়াম: ব্রিজ পোজ় (সেতু বন্ধাসন)
কীভাবে করবেন: মাটিতে পা সমতল করে শুয়ে পড়ুন এবং হাঁটু উপরের দিকে বাঁকিয়ে রাখুন। শ্বাস নিন এবং নিতম্ব তুলুন। মাটিতে শক্তভাবে হাত রাখুন। এই অবস্থানে শ্বাস নিন এবং শ্বাস ছাড়ুন। মূল অবস্থানে যাওয়ার জন্য নিতম্বকে আস্তে-আস্তে নিচের দিকে নামান। পুনরাবৃত্তি করুন।
কত বার করবেন: কমপক্ষে 2 থেকে 7 মিনিটের জন্য ব্রিজ পজ়িশনে থাকুন। ছোট-ছোট করে শুরু করুন। ব্রিজ পজ়িশনটি বজায় রাখার জন্য কেউ ইট বা অন্যান্য প্রপস ব্যবহার করতে পারেন।
উপকারিতা: হজম, থাইরয়েড রোগ এবং হাঁপানির সমস্যা সমাধান করে এই ব্যায়াম। পিঠের ব্যথা প্রতিরোধেও এই ব্যায়াম শ্রেষ্ঠ। যাঁদের PCOS (পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম) আছে, তাঁদের জন্য এই ব্যায়াম সুপারিশ করা হয়।
সতর্কতা: সাধারণত সকলের জন্যই এই ব্যায়াম নিরাপদ। তবে হাঁটুর ব্যথা রয়েছে যাঁদের, তাঁদের এটি এড়িয়ে চলাই ভাল।
মোদ্দাকথা
* মহিলাদের জন্য ব্যায়াম তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের চাবিকাঠি।
* BMR বাড়ানোর জন্য একজনকে প্রতিদিন কমপক্ষে 40 মিনিট ব্যায়াম করতে হবে।
* কাঁধ ঘোরানো, ঘাড় ঘোরানো, ব্রিজ পোজ়, এবং পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানোর মতো একাধিক ব্যায়াম মহিলারা ঘরে খুব সহজেই অনুশীলন করতে পারেন।