“শুধুমাত্র কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে আমি যোগামুদ্রা অভ্যাস শুরু করি। তবে তা আমার ক্ষেত্রে বেশ কাজ দেয়। যোগামুদ্রার কৌশল আমার হাতের আর পিঠের অসম্ভব যন্ত্রনা থেকে আমাকে অনেকাংশে আরাম দেয়,” বলেন মায়সুরুর জেএসএস ডেন্টাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডঃ প্রিয়াংকা নিতিন। ডঃ নিতিনের ডান হাতে প্রচন্ড ব্যাথা হত। তিনি ব্যাথা কমানোর জন্য স্প্লিন্ট এবং ওষুধ ব্যবহার করতেন কিন্তু তাতে তার দীর্ঘস্থায়ী কোনো উপশম হয়নি। যোগার দ্বারা উদ্ধার পাওয়ার আগে তিনি প্রায় দেড়বছর ধরে হাতের ব্যথায় ভুগেছিলেন। তিনি যোগায় আগ্রহী তাঁর ঠাকুমাকে, নিজের উদ্বেগের কথা জানান। প্রিংকার ঠাকুমা তাঁকে যোগা মুদ্রা করার কথা বলেন। “ যোগ অভ্যাসে যেহেতু কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, তাই একসপ্তাহ ধরে আমি নির্দিষ্ট কিছু যোগামুদ্রা চেষ্টা করলাম,ডঃ নিতিন জানান। প্রিয়াংকা এও বলেনে তিনি একসপ্তাহের মধ্যেই পার্থক্য খেয়াল করতে পেরেছিলেন এবং প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে বিভিন্ন মুদ্রাকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
একটি গবেষণায় এও দেখা গেছে যে দাঁতের ডাক্তারদের মধ্যে তাদের পেশাগত দেহভঙ্গিমার কারণে মাসকিউলোস্কেলিটাল ব্যাধি হবার প্রবণতা রয়েছে। ডঃ নিতিন তার রিভিউ পেপারে বিভিন্ন মুদ্রার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে যেখানে ব্যথা একটি অন্যতম উপসর্গ, স্বাস্থ্যের সেইরকম অবস্থার ক্ষেত্রে মুদ্রাগুলি উপকারী হতে পারে ।
মুদ্রাকে বোঝা
মুদ্রা হল একটি সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ হল বন্ধ করে রাখা, তালা বা ভঙ্গিমা। যোগা বিশেষজ্ঞরা বলেন যে হাত ব্যবহার করে বিশেষ করে আঙ্গুল ব্যবহার করে মুদ্রা অভ্যাস করা হয়ে থাকে। “ এই ভঙ্গিমাগুলি সারা শরীরে এমনভাবে এনার্জিকে প্রবাহিত করে যেটি ব্যথা উপশমে সাহায্য করে,” বেঙ্গালুরুর অর্থযোগ লিভিং যোগা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা শরত বাসবরাজু বলেন। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন ধারার শাস্ত্রীয় নৃত্যে অভিব্যক্তি ও আবেগকে প্রদর্শন করার জন্য মুদ্রা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
মুদ্রার মূল উপাদান ও তাদের সাথে আমাদের আঙ্গুলের সম্পর্ক
“ আমাদের হাতের পাঁচটি আঙ্গুল আমাদের শরীরের এবং প্রকৃতির এনার্জির পাঁচটি উপাদানের প্রতিনিধিত্ব করে,” বলেন বিহারের পাটনার সোহম যোগাধামের যোগা প্রশিক্ষক হৃতিকরাজ কুমার । কুমার আরও ব্যাখ্যা করেন যে পাঁচটি মৌলিক উপাদান (পঞ্চমহাভূত), যার মানে হল- মহাকাশ (আকাশ), বাতাস (বায়ু), আগুন (অগ্নি), জল (জল) এবং ভূমি (পৃথিবী) আমাদের শারীরিবৃত্তিকে বা শরীরে ফিজিওলজিকে প্রভাবিত করে। বুড়ো আঙ্গুল আগুনের প্রতীক, তর্জমা বায়ুর প্রতীক, মধ্যমা মহাকাশের প্রতীক, অনামিকা ভূমির প্রতীক এবং কনিষ্ঠা জলের প্রতীক। এগুলির মধ্যে যেকোনো একটার ভারসাম্যহীনতা শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটাতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন এই মুদ্রাগুলি এনার্জির ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।
মুদ্রার প্রকার
গবেষক সুনীতা এস এবং চন্দ্র প্রকাশ শর্মা তাদের রিভিউ পেপারে মুদ্রাগুলিকে নিম্নলিখিত শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেনঃ
১। যোগিক মুদ্রা- যোগিক অনুশীলনে ২৫ রকমের মুদ্রা রয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ হলঃ মহামুদ্রা, হঠযোগের অন্যতম প্রাচীনতম মুদ্রা, বলা হয় এটি একজন ব্যক্তির মানসিক সচেতনতা বাড়ায়। আরেক ধরনের মুদ্রা হল চিন মুদ্রা, যেটি জ্ঞানের মুদ্রা বলে পরিচিত।
২। আধ্যাত্মিক মুদ্রা- শান্তি, জ্ঞান এবং একাগ্রতা অর্জনে এই মুদ্রাগুলি ব্যবহৃত হয়। কয়েকটি উদাহরণের মধ্যে রয়েছে, জ্ঞান মুদ্রা (জ্ঞান অর্জনের জন্য) এবং ধ্যান মুদ্রা (ধ্যানের সময় মনোনিবেশ করার জন্য)।
৩। আরোগ্য মুদ্রা – এই ধরনের মুদ্রাগুলি শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য করা হয়ে থাকে। কয়েকটি উদাহরণের মধ্যে রয়েছে আপন মুদ্রা বা শরীরের দূষিত জিনিস শুদ্ধ করার মুদ্রা, সন্তান উৎপাদন এবং রজোচক্রের জন্য যোনি মুদ্রা বা গর্ভ মুদ্রা আর হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য হৃদয় মুদ্রা।
৪। ধর্মীয় মুদ্রা – নাম অনুযায়ী এগুলি ধর্মীয় প্রথার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এগুলিকে হয় নৃত্য শৈলীতে অথবা স্থাপত্যে (মুর্তি) লক্ষ্য করা যায়। কয়েকটি উদাহরণের মধ্যে রয়েছে ভূমিস্পর্শ মুদ্রা, যার অর্থ হল ভূমি স্পর্শ করা এবং অভয় মুদ্রা হল ভয়হীনতার ভঙ্গি।
৫। প্রথাগত মুদ্রা- এই ভঙ্গিমাগুলি নিজ উপকারিতার জন্য করা হয়ে থাকে। কয়েকটি উদাহরণের মধ্যে রয়েছে অঞ্জলি মুদ্রা, যার অর্থ হল একজন ব্যক্তিকে অভিবাদন করার ভঙ্গিমা, প্রার্থনা করা এবং আরাধনা করা আর প্রাণায়ম মুদ্রা করা হয়ে থাকে শ্বাসের ব্যায়াম করার সময়।
“প্রতিটি যোগা ঘরানার নিজস্ব শ্রেণীবিভাগ রয়েছে এবং প্রতিটি ঘরানায় মুদ্রার সংখ্যা বিভিন্ন হয়ে থাকে,” কুমার উল্লেখ করেন।
মুদ্রা ভঙ্গির পিছনে বিজ্ঞানের উপস্থিত
একটি গবেষণা পত্রে তিরুপতি নিবাসী হোমিওপ্যাথ এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ডঃ দীক্ষিতুলু একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটের উপমা ব্যবহার করে এনার্জির প্রবাহকে ব্যাখা করেছেন । তিনি আঙ্গুলকে বৈদ্যুতিক তারের সাথে এবং শরীরের সহজাত শক্তিকে বিদ্যুতের সাথে তলনা করেছেন। দুটি বা ততোধিক আঙ্গুলের ডগা ব্যবহার করে মুদ্রার অভ্যাস করা হয় এবং যখন তারা বৃদ্ধাঙ্গুলকে স্পর্শ করে , সার্কিটটি সম্পূর্ণ হয়, ফলের শক্তির প্রবাহ হয়। আরেক ধরনের ব্যাখ্যা হল মুদ্রা আক্যুপ্রেসারের মত। হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডঃ কুলদীপ সিং বলেন শক্তির প্রবাহের জন্য কয়েকটি নির্দিষ্ট পয়েন্টে (আক্যুপয়েন্ট) চাপ প্রয়োগ করে মুদ্রা আক্যুপ্রেসারের মত কাজ করে। একইভাবে আঙ্গুলের ডগার স্নায়ুর প্রান্তে চাপ দিয়ে মুদ্রা তার কাজ করে থাকে।
স্বামী বিবেকানন্দ যোগা অনুসন্ধান সমস্থানার বায়োএনার্জি বিভাগের কয়েকজন গবেষক বেঙ্গালুরুর এসভিওয়াইএএসএ যোগা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় তাদের গবেষণায় ইলেক্ট্রো ফোনেটিক ইমাজিং (ইপিআই) ব্যবহার করে মুদ্রার প্রভাবকে প্রদর্শন করেছেন। ইপিআই আঙ্গুল ঘিরে বৈদ্যুতিক প্রবাহ বা আলোকচ্ছটাকে বন্দী করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে চোখ বন্ধ করে পাঁচ মিনিটের জন্য শান্ত হয়ে বসে মুদ্রা অভ্যাস করলে কোনও কিছু আলাদা করে বোঝা যায় না। যদি বেশী সময় ধরে (কমপক্ষে ২০ মিনিট সময়) মুদ্রা অভ্যাস করা যায় তবে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ইপিআই প্যারামিটারে শক্তির প্রবাহকে লক্ষ্য করা যায়।
যোগামুদ্রায় কী কী সুবিধা পাওয়া যায়
মুদ্রার প্রচুর উপকারিতা রয়েছে, কিন্তু গবেষণা কয়েকটি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমিত রয়েছে। তবুও, বিভিন্ন ছোট-ছোট গবেষণা স্বাস্থ্যের বিভিন্ন অবস্থার উপরে মুদ্রার প্রভাবকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছে। সেগুলি হলঃ
- হাই ব্লাড প্রেসার
- পেলভিক ফ্লোরের কর্মহীনতা
- ইমিউনিটি বাড়ানো
- আপতকালীন তৎপরতা হিসাবে যোগামুদ্রা কোনও ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে অবধি তাঁর প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কাজে লাগতে পারে। এই নিয়ে ১৪ জনের উপর এক ছোটো মাপের সমীক্ষা হয়েছিল (ভি-মুদ্রা ব্যবহার)। মুদ্রার প্রভাবকে জানা ও বোঝার জন্য আরো অনেক গবেষণার প্রয়োজন।
- নিদ্রাহীনতা
- শ্বাসযন্ত্রের ব্যাধি
যোগা মুদ্রা পদ্ধতিতে শরীরে কিছু অনধিকার প্রবেশ করানোর দরকার হয় না এবং যে কেউ এটা অনুশীলন করতে পারেন। “ প্রথমে প্রক্রিয়াটি বোঝা আর তারপরে একজন শিক্ষিত যোগা শিক্ষকের থেকে শিক্ষা নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ,” বললেন বাসবরাজু। তিনি প্রাথমিক যোগাগুলি শেখার পরে অন্যান্য আরো মুদ্রা (যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়ম) অনুশীলন করার জন্যও মত দেন।