কেরলের কোট্টায়ামের শ্রুতি ম্যাথু সর্বদা সচেতন থাকেন যাতে তার ৯০ বছর বয়সী ঠাকুমা মেঝেতে পিছলে পড়ে না যান। তাঁর পরিবার খেয়াল রাখে যে বাথরুমের মেঝে যেন সবসময় শুকনো থাকে এবং বাড়িতে চলাফেরা করার সময় তিনি যেন সবসময় লাঠি ব্যবহার করেন। বাথরুমে গ্র্যাব বার লাগানো হয়েছে যাতে তিনি একা থাকলেও সাপোর্ট পান। ম্যাথু জানালেন, “সৌভাগ্যক্রমে, তিনি এখনও পর্যন্ত পড়ে যাননি, কিন্তু তাও আমরা সব সময় সতর্ক থাকি।”
বেঙ্গালুরুর মণিপাল হসপিটালসের জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের চেয়ারম্যান ডাঃ অনুপ অমরনাথ জানালেন যে পড়ে যাওয়া প্রবীণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা, তবে সতর্কতা অবলম্বন করলে এগুলি আটকানো যেতে পারে।
মুম্বাইয়ের মুলুন্দে অবস্থিত ফোর্টিস হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ডঃ শচীন ভোঁসলে বলেন যে পড়ে যাওয়ার ফলে বৃদ্ধরা গুরুতর-ভাবে আহত হতে পারেন, এবং পাঁজর, হিপ এবং মেরুদণ্ডে ফ্র্যাকচার হতে পারে। তিনি আরও জানালেন যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পড়ে যাওয়ার সময় ব্যক্তির কোনও জিনিসে ঠোকর লাগার ফলে মাথায় আঘাত লাগতে পারে। “পড়ে যাওয়ার পরে বয়স্করা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেন না। যদি পড়ে যাওয়ার ফলে হিপ ফ্র্যাকচার হয়, তাহলে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা এক বছরের বেশি জীবিত থাকেন না।” ডাঃ ভোঁসলের মতে পড়ে যাওয়ার পরে ফ্র্যাকচার প্রতিরোধ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ডাঃ অমরনাথ বলেন, পড়ে যাওয়ার একটি অন্তর্নিহিত কারণ থাকে। “বয়স্ক ব্যক্তি হয়তো মাথার আঘাত, ফ্র্যাকচার, হাতে-পায়ে আঘাত এবং সফ্ট–টিস্যুর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছেন, কিন্তু আমাদের এরই সাথে পড়ে যাওয়ার অন্তর্নিহিত কারণটিও খতিয়ে দেখতে হবে, এবং সেটা বুঝে চিকিৎসা করতে হবে। আমরা রিস্ক এসেসমেন্ট করি, যার মধ্যে পড়ে যাওয়ার কারণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।“
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেসন-এর ২০২১-র ফ্যাক্টশিট অনুযায়ী সারা বিশ্বে অনিচ্ছাকৃত আঘাতজনিত মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হল পড়ে যাওয়া। প্রতি বছর প্রায় ৬,৮৪,০০০ ব্যক্তি সারা বিশ্বে পড়ে যাওয়ার কারণে মারা যান। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের নাগরিক। ডব্লুএইচও–র (WHO) পরিসংখ্যান বলছে যে প্রতি বছর ৩৭.৩ মিলিয়ন পড়ে যাওয়া কেস এতটাই গুরুতর হয় যে সেগুলির চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।
পড়ে যাওয়ার কারণ
ডাঃ অমরনাথের মতে, পড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ কারণগুলি হলো:
বাহ্যিক কারণ
বাড়িতে বা বাইরে পিছলে যাওয়া, পাপোশ অথবা অসম জমিতে হোঁচট খাওয়া। কম আলোর জন্যও পিছলে গিয়ে পড়ে যাওয়া সম্ভব।
বাড়ির বাইরে অসমান ফুটপাথ বা হাঁটার পথ বা রাস্তার কারণে পড়ে যেতে পারেন
অভ্যন্তরীণ কারণ
প্রোপ্রিওসেপশন-এর (চলাফেরা, ক্রিয়া এবং অবস্থান বোঝার শারীরিক ক্ষমতা)অভাবের কারণে হতে পারে, যা প্রতিটি মাসল মুভমেন্টে উপস্থিত থাকে। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি এবং ভারসাম্য প্রক্রিয়ারও পড়ে যাওয়ার উপর প্রভাব থাকে।
যাদের গেইট অ্যান্ড ব্যালান্সের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি।
যাদের স্ট্রোক, গুরুতর নিউরোপ্যাথি (neuropathy) রয়েছে তাঁরাও পড়ে যেতে পারেন।
হাইপোনাট্রেমিয়া (সোডিয়ামের মাত্রা কম), হাইপোগ্লাইসেমিক (সুগারের মাত্রা কম) বা থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অস্বাভাবিকতার মতো মেটবোলিক (বিপাক সংক্রান্ত) জটিলতাগুলিও পড়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
- যাদের কগনিটিভ ডিসফাংশন (cognitive dysfunction) আছে (যেমন ডিমেনশিয়া রয়েছে এমন ব্যক্তিরা) তাঁদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি বেশি।
- পলিফার্মাসিও (একাধিক ওষুধ সেবন করা) পড়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টিসাইকোটিক, অ্যান্টি–অ্যালার্জি, পেইনকিলার, সেডেটিভস এবং ঘুমের ওষুধের মতো একাধিক ওষুধ বয়স্কদের মধ্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। এই সমস্ত কারণগুলি ছাড়াও, ডাঃ অমরনাথ হ্যাপিয়েস্ট হেলথকে বলেন, “সারকোপেনিয়া (sarcopenia)[বার্ধক্যজনিত কারণে স্কেলেটল মাসল মাস এবং শক্তি কমে যাওয়া] ঝুঁকির একটি বিশিষ্ট কারণ। বয়স বাড়ার সাথে, রিয়্যাকশন টাইম কমে যায় এবং এটি আরেকটি হাই রিস্ক ফ্যাক্টর।”
পুরানো এবং নতুন ধারার চিকিৎসা
চিকিৎসার বিষয়ে ডাঃ অমরনাথ জানালেন যে ব্যক্তি যে সমস্ত ওষুধ সেবন করছেন সেগুলির রিস্ক এসেসমেন্ট করা হয় এবং তাঁর নিয়মিত ওষুধগুলির মধ্যে কোনোটা “ব্যক্তির পক্ষে বেশি লাভের, না তাতে ঝুঁকি বেশি“ সেটা যাচাই করা হয়।
প্রযুক্তিগত কিছু অগ্রগতিও সাহায্য করে। ওয়েরেবল ডিভাইস পড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অ্যালার্ম বাজাতে পারে এবং কিছু ডিভাইস ব্যবহারকারীর চলাফেরা, ভঙ্গি এবং ভারসাম্যের ভিত্তিতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার মূল্যায়নও করে।
চিকিৎসকরা একটি নির্দিষ্ট স্ক্রীনিং পদ্ধতি টাইমড আপ এবং গো টেস্ট (টিইউজিটি TUGT) ব্যবহার করেন, যা ফাংশন্যাল মবিলিটির একটি কর্মক্ষমতা পরিমাপ। টিইউজিটি পরীক্ষা করার সময় ব্যক্তিকে চেয়ার থেকে উঠে দশ ফুট হাঁটতে, এবং ঘুরে আবার চেয়ারে এসে বসতে বলা হয়। ডাঃ অমরনাথ বলেন, “সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া ১২ সেকেন্ডের মধ্যে শেষ হওয়া উচিত। যদি কেউ ১২ সেকেন্ডের বেশি সময় নেয় তবে অন্যান্য আরও পরীক্ষা করা দরকার এবং এটি পড়ে যাওয়ার ঝুঁকির নির্দেশ। আমাদের পরীক্ষা করতে হবে যে কোন ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগছে – ঘুরে দাঁড়াতে না বসার এবং হাঁটার সময়, এবং এটা সেনসারি নাকী মাসলের সমস্যা।” টিইউজিটি(TUGT) একটি খুব ভাল নন-ইনভেসিভ স্ক্রীনিং টুল যা পড়ে যাওয়ার রিস্ক এসেসমেন্ট এবং কার্যকরী ক্ষমতা পরীক্ষা করতে পারে। এর পর সুগার, সোডিয়াম, থাইরয়েড এবং ইনফেকশন আছে কী না সেটা জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা যেতে পারে। নিউরোলজিকাল এসেসমেন্টও করা হয়।”
বয়স্কদের ক্ষেত্রে পড়ে যাওয়া কীভাবে প্রতিরোধ করবেন
বেঙ্গালুরু নিবাসী ভি রবিচন্দর জানালেন যে তার আন্টি (যার বয়স তখন ৮০+ এবং পাশের বাড়িতে থাকতেন ) গলায় একটি এআই (AI)-ভিত্তিক ওয়েরেবল ডিভাইস ব্যবহার করতেন। রবিচন্দর বলেন, “ডিভাইসটি পড়ে যাওয়ার রিস্ক এসেসমেন্ট করতে পারত না, কিন্তু আন্টি পড়ে গেলে তাঁর পাঁচটি পরিচিতকে এমার্জেন্সি কল করে অবিলম্বে জানিয়ে দিতে পারত।” আন্টি অবশ্য কোনওদিন পড়ে যাননি, এবং ২০২১ সালে বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে মারা যান। তবুও, পরিবার এমন ব্যবস্থা করে রেখেছিল যাতে তিনি পড়ে গেলে অবিলম্বে তাঁর কাছে সাহায্য পৌঁছে যায়।
ডাঃ অমরনাথ জানান যে এছাড়াও গাইরোস্কোপ সেন্সর লাগানো স্মার্ট ওয়েরেবল ডিভাইস রয়েছে যা কোনো বস্তু এবং ব্যক্তির অরিয়েন্টেশন এবং অ্যাঙ্গুলার ভেলোসিটি নির্ধারণ করে এবং বজায় রাখে। “গাইরোস্কোপ সেন্সর তাৎক্ষনিক মূল্যায়ন করে যে ব্যবহারকারী পড়ে যাচ্ছে কিনা এবং অবিলম্বে সাহায্য সুনিশ্চিত করার জন্য অ্যালার্ম বজায়।”
ডাঃ ভোঁসলের মতে ঘরোয়া স্তরে এমন কিছু ব্যবস্থা করা সম্ভব যা পড়ে যাওয়া আটকাতে পারে। তিনি বলেন, বাড়িতে হোঁচট লাগতে পারে এমন জায়গা, পিচ্ছিল টাইলস, জমা জল যেন না থাকে। “পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং অ্যান্টি–স্লিপ পেইন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিদের চলাফেরার জায়গা এমনভাবে ডিজাইন করা উচিত যাতে তাদের খুব বেশি ঘুরতে না হয়। তাঁরা যেসব ঘর ব্যবহার করেন – যেমন স্টাডি, লিভিং রুম এবং টয়লেট – এগুলি কাছাকাছি থাকা উচিত।” ডাঃ ভোঁসলে আরও জানান যে রাতে যাতায়াত করার জায়গাগুলি এবং বাথরুমে হালকা আলোর ব্যবস্থা রাখলে তাঁদের সুবিধা হবে।
ডাঃ অমরনাথ বলেন, গেইট এণ্ড ব্যালান্স থেরাপি একজন ব্যক্তিকে হাঁটাতে, ভারসাম্য এবং ভঙ্গিমা উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। তিনি জানান, “এক পা-ওয়ালা লাঠির বদলে তিন পা-ওয়ালা (ট্রাইপড) হাঁটার লাঠি ব্যবহার করা ভাল। রিস্ক এসেসমেন্টের ভিত্তিতে আমরা কিছু মানুষকে জিমার ফ্রেম ব্যবহার করতে বলি, একটি একধরনের মেটালিক ওয়াকিং ফ্রেম। সামনের দিকে চাকা লাগানো মেটালিক ওয়াকিং ফ্রেমও ব্যবহার করা যেতে পারে, যাকে রোলেটর বলা হয়। যাদের চলাফেরা করতে অসুবিধা হয় তাদের আমরা হুইলচেয়ার ব্যবহার করার পরামর্শ দিই। তবে এই সরঞ্জামগুলি কার্যকারীভাবে ব্যবহার করার জন্য একটি ইকোসিস্টেমের দরকার।”
ডাঃ ভোঁসলে বলেন যে ভিটামিন এবং ক্যালসিয়ামের ঘাটতি যাতে না হয় সেই দিকে নজর রাখা এবং ভাল, পুষ্টিকর খাবার পড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। বয়স্কদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা এবং রিফ্লেক্স আর কোঅর্ডিনেশনের উন্নতিতে তাঁদের সাহায্য করে।