বার্ধক্যের একটি স্বাভাবিক দিক হল স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া। বয়স বাড়ার সাথে সাথে লোকেরা লক্ষ্য করেন যে তারা তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা হারাতে শুরু করেছেন: যেমন অনেক বয়স্ক ব্যক্তি প্রায়শই সময়মতো ওষুধ খেতে ভুলে যান বা চশমা এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলেন।
কিন্তু এদের মধ্যে আছেন এমন কিছু বয়স্ক মানুষ যারা একেবারেই আলাদা তাঁরা হলেন সুপার-এজাররা- আশি বছর বা তার বেশি বয়সের কিছু লোকের স্মৃতিশক্তি এবং জ্ঞানীয় ক্ষমতা বয়সের সাথে হ্রাস পায় না।
সোলাপুরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা বনমালা কিনিকারের কথাই ধরা যাক যিনি ১২ বছর বয়স থেকে একজন শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী। ৮৫ বছর বয়সে কিনিকার একটি নাচের স্কুল চালান। তিনি খুব সহজেই তার শৈশবের দিন এবং ঘটনাগুলি মনে করতে পারেন।
কিনিকার বলেছেন “সপ্তম শ্রেণীতে কোরিওগ্রাফি করা আমার প্রথম নাচের সিকোয়েন্সটা আমার স্পষ্টভাবে মনে আছে”। এই সুপার-এজার আরও বলেন “আমি নতুন জিনিস শিখতে, রান্না করতে এবং ঘরের কাজ করতে ভালোবাসি” । যদিও তার সমসাময়িকদের অনেকের ক্ষেত্রে স্মৃতি এবং চিনতে পারার সমস্যার মুখোমুখি হওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা।
সুপার এজার আর সুপার নিউরন
কিনিকারের মতো আরও বেশ কিছু সুপার-এজার রয়েছেন এবং গবেষকরা এই বয়সকে পরাহত করে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতার অন্তর্নিহিত কারণগুলি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ইলিনয়ের গবেষকদের একটি বিশেষভাবে নিয়োজিত সুপার এজিং রিসার্চ প্রোগ্রাম রয়েছে যা ৮০-প্লাসের মধ্যে তীক্ষ্ণ স্মৃতি এবং জ্ঞানীয় কার্যকারিতার সাথে জড়িত নিউরাল মেকানিজম/ স্নায়ু পদ্ধতি সম্পর্কে অধ্যয়ন করছে।
সেরিব্রাল কর্টেক্সে প্রকাশিত 2021 সালের একটি গবেষণায় নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ডঃ তামার গেফেন এবং তার দল শনাক্ত করেছে যে সুপার-এজারদের মস্তিষ্কের কোষে টাউ ট্যাঙ্গেল এবং অ্যামাইলয়েড বিটা প্রোটিন জমা হয় না। তারা অনুমান প্রকাশ করেছেন যে এটি তাদের সংরক্ষিত স্মৃতির কারণ হতে পারে।
2022 সালে গবেষণা অব্যাহত রেখে তারা নিউরোসায়েন্স জার্নালে আরেকটি গবেষণা প্রকাশ করেন। তারা বিভিন্ন বয়স এবং অবস্থার ২৪ জন মৃত ব্যক্তির মস্তিষ্কের স্ক্যান পরীক্ষা করেন: ছয়জন সুপার এজার, সাতজন জ্ঞানীয়ভাবে গড় বয়সের প্রবীণ, ৩০-৪০ বছরের ছয়জন ব্যক্তি এবং অন্য পাঁচজন যারা প্রাথমিক পর্যায়ে আলজাইমার রোগে আক্রান্ত।
এই সমস্ত স্ক্যানে তারা টাউ ট্যাঙ্গেল গঠনগুলি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এবং মস্তিষ্কের মধ্যবর্তী অঞ্চলের দ্বিতীয় স্তরে (এন্টোরহিনাল কর্টেক্স) নিউরনের আকার পরিমাপ করেন। মস্তিষ্কের এই অঞ্চলটি স্মৃতি, দিক নির্ণয় নিয়ন্ত্রণ এবং সময় বোঝার জন্য দায়ী।
তারা দুটি উল্লেখযোগ্য দিক লক্ষ্য করেছেন:
- অধ্যয়নে অংশগ্রহণকারী কগনিটিভ প্রবীণ এবং ৩০-৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিদের তুলনায় সুপার-এজার গ্রুপের মস্তিষ্কের কোষগুলি এবং তাদের নিউরনও বড় ছিল।
- আলজাইমার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে টাউ ট্যাঙ্গেল এবং অ্যামাইলয়েড বিটা প্রোটিন জমা হওয়ার কারণে নিউরন ছোট ছিল।
গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে বড় নিউরনগুলি তাদের গঠনগুলি ভালভাবে বজায় রাখে। ডাঃ গেফেন হ্যাপিয়েস্ট হেলথকে বলেন “সুপার-এজারদের তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির একটি সম্ভাব্য কারণ হল এই বৃহৎ নিউরনগুলি টাউ প্রোটিন ট্যাঙ্গেল থেকে সুরক্ষিত থাকা”।
যদিও তিনি যোগ করেন “আমি নিশ্চিত নই কেন সুপার-এজারদের মধ্যে নিউরনগুলি বড় ছিল বা কেন এই ব্যক্তিরা আলজাইমার রোগ থেকে তুলনামূলকভাবে অধিক সুরক্ষিত।”
‘সুপার-এজারদের মস্তিষ্ক কী অনন্য করে তোলে?’ এবং ‘কীভাবে আমরা বৃদ্ধদের আলজাইমার রোগ থেকে বাঁচতে তাদের জৈবিক চরিত্রগুলিকে কাজে লাগাতে পারি?’ এমন কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দলটি দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ভবিষ্যতে সমাধান
কীভাবে এবং কেন সুপার-এজারদের মধ্যে নিউরোনাল অখণ্ডতা সংরক্ষিত থাকে তা বোঝার জন্য এই গবেষণাটি ভবিষ্যতের অধ্যয়নের জন্য পথ খুলে দিয়েছে এবং এই কোষগুলির বিপাকীয়, রাসায়নিক এবং জেনেটিক কারণগুলির উপর ফোকাস ও মনোনিবেশ করা হয়েছে।
বেঙ্গালুরুর নিউরোসায়েন্স সেন্টার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক শ্রীধরন দেবরাজন ব্যাখ্যা করেছেন “টাও ট্যাঙ্গেল গঠনের কারণে অনুমান করা হয় যে নিউরোনাল সংকোচন, নিউরনের ক্ষতি এবং তাদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যহত হয়। এগুলি আলজাইমারের মতো রোগের বিকাশের মূল কারণ হতে পারে।” তিনি বলেছেন যে গবেষকরা যদি এই সুপার নিউরনগুলিকে কোন এমন জিনিস যা একরম অসাধারণ করে তোলে তার উত্তর খুঁজে পেতে পারেন তবে এটি নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের সমাধান খুঁজে পেতে সহায়তা করতে পারে।
ডাঃ দেবরাজন বলেছেন “সুপার নিউরনের নিউরোপ্রোটেক্টিভ মেকানিজম যখন আবিষ্কৃত হয় তখন আরও বেশি দুর্বল সংখ্যার ডিমেনশিয়া এবং প্রাথমিক পর্যায়ের আলজাইমার রোগের [থেকে] মস্তিষ্কের নিউরনগুলিকে রক্ষা করার সম্ভাবনা থাকতে পারে” ।
সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত নিউরোডিজেনারেটিভ রোগগুলির ক্ষেত্রে বর্তমানে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং লক্ষণগুলির জন্য কয়েকটি ওষুধ দিয়ে সমাধান করা হয়। শারীরিক এবং মানসিকভাবে সক্রিয় থাকা রোগ কমাতে সহায়ক হয়।
নৃত্যশিল্পী কিনিকারকে তার চটপটে মন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন “বই পড়া, লেখালেখি এবং শিল্পচর্চার মতো ক্রিয়াকলাপ আমাকে ইতিবাচক থাকতে সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যায়াম এবং পুষ্টিকর খাবার আমাকে সুস্থ রাখে।” মানসিকভাবে তরুণ এবং চটপটে থাকার জন্য দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে সকলেরই কিছুটা সময় বের করা উচিত।