প্রচণ্ড গরমের একটা দিনের কথা বলছিলেন গুয়াহাটির গৃহিনী মালবিকা কাকাতি। অলস, হাসিঠাট্টা মুখর একটা দিন মালবিকার সাত বছরের ছেলে অগস্তির জন্য কী ভাবে ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়, সে কথা বলতে গিয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল তাঁর। ছোট্ট অগস্তি তখন খেলনা নিয়ে খেলা করছিল। হঠাৎই সে ব্যথায় চিৎকার করতে থাকে…
“আমি দেখলাম, ছেলেটার নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে এবং আমরা তাকে তড়িঘড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই,” বললেন মালবিকা। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি পরীক্ষা করেন। “ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেন যে, অগস্তির নাকে একটা খেলনা আটকে রয়েছে, যার কারণে রক্তপাত হচ্ছিল,” যোগ করলেন তিনি।
ফরিদাবাদের সর্বোদয় হাসপাতালের ইএনটি অ্যান্ড কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট বিভাগের ডিরেক্টর ডাঃ রবি ভাটিয়া বলছেন, নাক দিয়ে রক্তপাতকে চিকিৎসার ভাষায় এপিস্ট্যাক্সিস বলা হয়। এপিস্ট্যাক্সিস বলতে অনুনাসিক গহ্বরের অভ্যন্তরীণ টিস্যু থেকে রক্ত নিঃসরণকে বোঝায়, যা ফেটে যাওয়ার কারণে ঘটে। ডাঃ ভাটিয়া ব্যাখ্যা করে বললেন, “এটি একটি বা উভয় নাকের মধ্যেই ঘটতে পারে। নাক থেকে রক্তপাত কখনও ছোটখাট ঘটনা থেকে কখনও আবার গুরুতর সমস্যা পর্যন্ত হতে পারে।”
নাক দিয়ে রক্তপাতের বিভিন্ন ধরন
ডাঃ ভাটিয়া বলছেন, নাক থেকে রক্তপাতের মোট দুটি ভিন্ন ধরন রয়েছে:
1. নাকের সামনের অংশের রক্তনালী থেকে অগ্রবর্তী নাকের রক্তপাত হয়, যা অনেকটাই বেশি পরিমাণে হয়।
2. অনুনাসিক গহ্বরের আরও গভীরে রক্তপাত হতে পারে, যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে।
নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ
ডাঃ ভাটিয়ে বলছেন, নাক দিয়ে রক্তপাতের একাধিক কারণ রয়েছে, যা বিশেষ করে গরমকালে হয়। “শুষ্ক বাতাস, নাক ডাকা, ট্রমা, অ্যালার্জি, সাইনাস সংক্রমণ, উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্ত জমাট বাঁধার মতো একাধিক কারণ থাকতে পারে নাক থেকে রক্ত পড়ার পিছনে।”
ব্যাঙ্গালোরের ফর্টিস হাসপাতালের ইএনটি বিশেষজ্ঞ ডাঃ এইচ কে সুশীন দত্ত বলছেন, নাক দিয়ে রক্ত পড়ার পিছনে জলবায়ুরও যথেষ্ট ভূমিকা থাকতে পারে। বিশেষ করে গরমকালে বেশি করে নাক দিয়ে রক্তপাত হয়। এই সময় শুষ্ক পরিবেশের কারণে অনুনাসিক প্যাসেজগুলি শুষ্ক হয়ে যায়। আর সেখান থেকেই রক্তনালী থেকে রক্তপাতের প্রবণতা তৈরি হয়।
নাক থেকে রক্তপাতের ঝুঁকি যে সব কারণে বেড়ে যায়
ডাঃ ভাটিয়ার মতে, এপিস্ট্যাক্সিস বা নাক থেকে রক্তপাত সব বয়সের মানুষজনেই হতে পারে। তবে তা শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। শিশুরা এপিস্ট্যাক্সিস প্রবণ হয়, কারণ তাদের নাকের রক্তনালীগুলি পৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে এবং সহজেই রক্তপাত হতে পারে। বয়স্করা তাঁদের নাকের রক্তনালীগুলির ভঙ্গুরতার কারণে নাক দিয়ে রক্তপাত অনুভব করতে পারেন।
ডাঃ দত্ত জানাচ্ছেন, নাকের সেপ্টাল বিচ্যুতি কারণে মানুষজনের অনেক সময়ই এপিস্ট্যাক্সিসের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে যখন তীক্ষ্ণ স্পার্স (নাকের পথ) অনুষঙ্গী হয়। নাকের সেপ্টাল বিচ্যুতি হল এমন একটি অবস্থা, যেখানে নাকের সেপ্টাম (তরুণাস্থি এবং হাড়) নাককে দুটি নাসারন্ধ্রে বিভক্ত করে।
আবার, যাঁদের গুরুতর অ্যালার্জি আছে, তাঁদেরও নাক দিয়ে রক্ত পড়ার প্রবণতা বেশি। ধূমপান এবং অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট থেরাপি (প্রস্থেটিক হার্ট ভালভযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য থেরাপি) নাক থেকে রক্তপাতের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিদের তুলনায় শিশুদের সাধারণত অগ্রবর্তী নাক থেকে রক্তপাত বেশি হয়।
খুব জোরে নাক খুঁটলেও তা থেকে রক্ত পড়তে পারে। এছাড়াও, হাই ব্লাড-প্রেসারের কারণেও নাক থেকে রক্তপাত হতে পারে, যার জন্য অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন।
নাক দিয়ে রক্তপাতের নির্ণয়
রোগীর নাকের পরীক্ষার মাধ্যমে তা থেকে রক্তপাত নির্ণয় করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে আবার একজন বিশেষজ্ঞ অন্তর্নিহিত কারণ খোঁজার জন্য আরও পরীক্ষার সুপারিশ করতে পারেন, যার মধ্যে রয়েছে অনুনাসিক এন্ডোস্কোপি এবং রক্ত পরীক্ষা।
নাক দিয়ে রক্তপাতের চিকিৎসা
ডাঃ ভাটিয়ার কথায় নাক থেকে রক্তপাত বন্ধ করার একাধিক চিকিৎসা রয়েছে, যার মধ্যে বেশ কিছু আপনি বাড়িতে বসেই করতে পারবেন:
1. রক্তপাত বন্ধ করতে নাকের ছিদ্র দুটি দুই আঙুল দিয়ে হাল্কা করে চেপে ধরে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ুন।
2. নাকে একটি ঠান্ডা কম্প্রেস প্রয়োগ করুন।
3. অনুনাসিক প্যাসেজ আর্দ্র রাখতে স্যালাইন স্প্রে বা হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন।
4. আরও গুরুতর ক্ষেত্রে গজ বা বিশেষ বেলুন দিয়ে নাসাল প্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে।
5. তবে কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।
এপিস্ট্যাক্সিসের ধরন এবং তীব্রতার উপর নির্ভর করে তার চিকিৎসার পদ্ধতিগুলি পরিবর্তিত হতে পারে। সামনের দিকের নাক দিয়ে রক্তপাত সাধারণ ঘরোয়া প্রতিকারের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। অন্য দিকে নাকের পিছন থেকে রক্তপাত হলে নাকের প্যাকিং বা ক্যাটারাইজেশনের মতো চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
মালবিকা কাকাতি বলছেন, অভিভাবকদের তাঁদের কৌতূহলী সন্তানের হাত থেকে ছোট জিনিসগুলিকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। কারণ তার ফলে দুর্ঘটনা হতে পারে এবং তা থেকে নাক দিয়ে গুরুতর ভাবে রক্তপাত হতে পারে। তিনি আরও যোগ করে বললেন, “ডাক্তার আমার ছেলেকে একটা নাসাল স্প্রে দিয়েছিলেন এবং সেটি পাঁচ দিন ব্যবহার করতে বলেছিলেন।” তারপর থেকে আর তাঁর সন্তানের নাক দিয়ে রক্ত পড়েনি বলে জানালেন মালবিকা।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে নাক দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করা যায়। ডাঃ দত্ত এবং ডাঃ ভাটিয়া উভয়েই বেশ কিছু টিপসের কথা বলছেন:
1. বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা বাড়াতে বিশেষ করে শুষ্ক আবহাওয়ায় একটি হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন।
2. জোরে নাক খোঁটা বা তাতে কাঠি বা অন্য কোনও বস্তু ঢোকানো এড়িয়ে চলুন।
3. অনুনাসিক প্যাসেজ আর্দ্র রাখতে একটি স্যালাইন নাসাল স্প্রে ব্যবহার করুন।
4. নাকের ছিদ্রের ভিতরে পেট্রোলিয়াম জেলির একটি পাতলা স্তর প্রয়োগ করুন যাতে, সেগুলি শুকিয়ে না যায়।
5. অ্যালার্জি বা উচ্চ রক্তচাপের মতো অন্তর্নিহিত অবস্থাগুলি পরিচালনা করুন যা নাক দিয়ে রক্তপাতের কারণ হতে পারে।