হাতে গোনা কয়েক দিনের মধ্যেই হোলি। আর হোলি মানেই রং, পিচকারি সঙ্গে অনেক মিষ্টি কেনা। তবে রং খেলার আগে সঠিক প্রস্তুতি দরকার। রঙের মধ্যে থাকা রাসায়নিক থেকে অ্যালার্জি হতে পারে। রঙে অ্যালার্জি রয়েছে যাঁদের, তাঁদের চুলকানি, ফুসকুড়ি থেকে শুরু করে শ্বাসকষ্ট, হাঁচি-কাশির মতো নানাবিধ উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
বেঙ্গালুরুর গ্রাফিক ডিজ়াইনার মেঘা কে রং থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকেন। হোলি খেলেন ঠিকই, তবে যতটা পারেন রং এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। হ্যাপিয়েস্ট হেলথের কাছে জানালেন, রঙের গুঁড়োর সংস্পর্শে এলে তিনি হাতের তালুতে একরকমের জ্বালা অনুভব করেন।
ছোটবেলার কথা তুলে ধরে মেঘা বললেন, “যতবারই আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে হোলি খেলতাম, কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্নান করার জন্য বাড়ি চলে যেতাম। কারণ, আমার সারা শরীরে চুলকানি হতে থাকত। আমার মুখে, হাতে এবং ঘাড়ে ফুসকুড়ি পর্যন্ত হয়ে যেত। আমার দাদা ও দিদিরা আমাকে পরামর্শ দিত রং খেলার আগে তেল মাখতে। কিন্তু তাতে আরও বেশি করে জ্বালা করত।”
মেঘার এই সমস্যা ধরতে পারেন তাঁর মা। হোলির আগে বাড়িতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে রং তৈরি করে তিনি দেখেন, তাতে মেয়ের কোনও সমস্যা নেই। তখনই মেঘা ও তাঁর পরিবার পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কৃত্রিম রঙের কারণেই তাঁর গা-হাত-পা চুলকাতে থাকত।
মেঘার কথায়, “এখন আমি, আমার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দিব্যি হোলি খেলি। আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে অর্গ্যানিক রং ব্যবহার করি, যা আমাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করে না।”
হোলি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা
অনেককেই দেখা যায়, হোলির আগে হাতের তালু, মুখে তেল মেখে নিতে। এমনটা করার পিছনে তাঁদের ধারণা হল, এর ফলে তাড়াতাড়ি রং উঠে যাবে। চিকিৎসকরা বলছেন, এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। বরং, তেল মাখলে রংগুলি দীর্ঘসময় ধরে ত্বকে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে জানাচ্ছেন ডাক্তাররা।
ম্যাঙ্গালুরুর কেএমসি হাসপাতালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ গাথা এম উপাদ্য বলছেন, হোলি খেলার আগে আপনার ত্বকে তেল লাগালে তা আরও খারাপ হবে। কারণ, রঙের পাউডার ত্বকে লেগে থাকবে এবং সেই রং তোলা আরও কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।
হোলির রং কি অ্যালার্জির কারণ হতে পারে?
একজন ব্যক্তির যদি কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস থাকে, তাহলে কৃত্রিম রঙের রাসায়নিকগুলি অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যার ফল খুবই খারাপ হতে পারে। ডাঃ উপাদ্য বলেছেন, “কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস বা রাসায়নিক অ্যালার্জির ইতিহাস রয়েছে, এমন ব্যক্তির কৃত্রিম রং থেকে দূরে থাকাই ভাল। এই ধরনের রং তাঁদের ত্বককে প্রভাবিত করবে, যার ফলে চুলকানি, ফুসকুড়ি এবং অ্যালার্জি হতে পারে।”
তিনি আরও যোগ করে বললেন, “কৃত্রিম রং এতটাই খতরনাক যে, দীর্ঘদিন ধরে ত্বকে রাসায়নিক পদার্থের প্রভাব বিস্তার করে, যার ফলে চুলকানি পর্যন্ত হতে পারে।” “কালার পাউডার থেকে অনেকের আবার ব্রণ দেখা দিতে পারে। তরলের সঙ্গে মিশে এই রং ও তার ক্ষতিকারক রাসায়নিকগুলি ত্বকে লেগে থাকে। তাই, রং খেলার সময় একজনকে অতি অবশ্যই প্রাকৃতিক এবং দৈব বিকল্পগুলি ব্যবহার করতে হবে,” বলছেন ডাঃ উপাদ্য।
হোলির রং নিঃশ্বাসে গেলে আরও বিপদ
যোধপুরের অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (AIIMS)-এর পালমোনারি মেডিসিন বিভাগের অ্যাডিশনাল প্রফেসর ডাঃ নবীন দত্ত বলছেন, হোলির রং যদি কারও নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় চলে যায়, তাহলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সেক্ষেত্রে অতি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত বলে জানালেন তিনি।
তিনি আরও বলছেন, “আগে শুধু মানুষের গায়েই রং লাগত। এখন বাতাসেও রং ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা রয়েছে। সেটা হয়তো শুধুই ভাল ছবি তোলার জন্য। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া সেই রঙিন পাউডার থেকে হাঁচি-কাশি, শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। হোলি খেলার পর যখন অনেক রোগী আমাদের কাছে এই উপসর্গ নিয়ে হাজির হন, তখন আমরা পরিষ্কার বুঝে যাই বাতাসে এই রংগুলি ছড়িয়ে পড়ার ফলে অ্যালার্জি হয়েছে।”
বেশ কয়েক বছর আগে এমনই এক রোগী তাঁর কাছে হাজির হয়েছিলেন। সেই রোগীর কথা বলতে গিয়ে ডাঃ নবীন দত্ত বললেন, “কম বয়সী একটা ছেলে, যে 20 বছর বয়সে যোধপুরে রঙের প্যাকেজিংয়ের কাজ করত। হোলির দিন দুয়েক আগে থেকে তার তীব্র কাশি শুরু হয় এবং শ্বাসকষ্টেও ভুগতে থাকে। সংক্রমণ এমনই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছয় যে, তাঁর নিউমোনিয়া দেখা দেয়। হোলি খেলার পরে শ্বাসযন্ত্রের অ্যালার্জি আসলে কৃত্রিম রং থেকে সৃষ্ট চর্মরোগের থেকে অনেকটাই বেশি গুরুতর হয়।”
হোলির রং ক্ষতি করতে পারে আপনার চোখেরও
ডাঃ উপাদ্য বলছেন, “হোলির উৎসব যখন চলতে থাকে, তখন আমাদের অনেকেরই চোখ জ্বালা করে। আমাদের চোখ যথেষ্ট সংবেদনশীল এবং রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলে তাতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই, চোখ জ্বালা করলে তা অবিলম্বে ধুয়ে ফেলতে হবে। চোখে লালভাব-সহ যদি জ্বালা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয়, তাহলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।”
নিরাপদে হোলি খেলতে বিশেষজ্ঞরা এগুলি মেনে চলতে বলছেন:
* আপনার ত্বক যেন সর্বদা ময়েশ্চারাইজ়ড্ থাকে।
* রাসায়নিকমুক্ত শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার দিয়ে আপনার মাথার স্ক্যাল্প পরিষ্কার করে চুল ঠিক করুন।
* হাল্কা গরম জল দিয়ে আপনার ত্বকের রং ধুয়ে ফেলুন, শক্ত ভাবে ঘষতে যাবেন না।
* হোলির বিষাক্ত রং থেকে আপনার চুলকে রক্ষা করতে একটি শাল বা ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রাখুন।
মোদ্দাকথা
* কৃত্রিম রঙে থাকা রাসায়নিক থেকে অ্যালার্জি হতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার ত্বক, শ্বাসযন্ত্র এবং চোখের অ্যালার্জির লক্ষণগুলির দিকে নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
* সেই কারণেই চিকিৎসকরা কৃত্রিম রঙের পরিবর্তে অর্গ্যানিক বা জৈব রং ব্যবহার করার পরামর্শ দেন।
* যদি কেউ ত্বক, চোখ বা গলায় জ্বালা অনুভব করে, তাহলে তাঁকে অবিলম্বে সেই রং ধুয়ে ফেলতে হবে এবং লক্ষণগুলি অব্যাহত থাকলে একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা উচিত।