
রক্তদান এমন এক জনকল্যাণকর কাজ যা বিশ্বজুড়ে অগণিত জীবনকে বাঁচায়। কিন্তু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধের কারণে টাইপ ১ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিদের জন্য রক্তদান করার বিষয়টি কঠিন হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যথাযথ প্রস্তুতি এবং রক্তদান-পরবর্তী সতর্কতা সহ কঠোরভাবে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করা হলে, তবেই দাতা এবং প্রাপক উভয়ের জন্য এটি এক নিরাপদ রক্তদান প্রক্রিয়াকে নিশ্চিত করতে পারে। তারা আরও বলেন যে প্রাপকরা যদি ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ করে তবে তাদের শরীরে কিন্তু এরকম কোনও উপসর্গ দেখা যাবে না
এছাড়াও, সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে যে রক্তদানের পরে শরীরে আয়রনের মাত্রা হ্রাস পেলে তা ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ায়, যা সাময়িকভাবে ইনসুলিনের উৎপাদন এবং গ্লুকোজ টলারেন্সকে বাড়াতে পারে।
ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিরা কি রক্তদান করতে পারেন?
বেঙ্গালুরুর অ্যাস্টার CMI হাসপাতালের হেমাটোলজি, হেমাটো-অনকোলজি, পেডিয়াট্রিক হেমাটো-অনকোলজি এবং বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ডাঃ অনুপ পি, বলেন শহরের অনেক ব্লাড ব্যাঙ্ক যাদের ডায়াবেটিস আছে বা সেজন্য তারা ওষুধ খাচ্ছেন সেইসব রক্তদাতাদের রক্ত নেওয়ার অযোগ্য বলে ঘোষণা করে৷ “তবে এটি করার কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এটা বেশ খানিকটা অসম্ভাব যে কোনও এমন একজন ব্যক্তি যার রক্তে ব্লাড সুগারের মাত্রা সুনিয়ন্ত্রিত তার থেকে নেওয়া রক্ত গ্রহীতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এগুলি কেবল অনুমান করা হয় যে কেউ যদি অ্যান্টি-ডায়াবেটিক ওষুধ খায় তবে তাদের রক্তে সেই ওষুধের কিছু পরিমাণ মিশে থাকবে যা প্রাপকের ব্লাড সুগারের মাত্রাকে হয়তো কমিয়ে দিতে পারে,” তিনি বলেন। সুনিয়ন্ত্রিত টাইপ ২ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ আছে এমন ব্যক্তিদের রক্তদান করা থেকে বিরত থাকার দরকার নেই, যদি ব্লাড ব্যাঙ্ক তা গ্রহণ করে, তিনি আরও বলেন।
ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি সাধারণত অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক থাকে যাতে দাতা এবং গ্রহীতা উভয়েরই সুস্থতা নিশ্চিত করা যায়। কোচির KMK হাসপাতালের ইন্টার্নাল মেডিসিন, এন্ডোক্রিনোলজি এবং ডায়াবেটিস বিভাগের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর, চিফ মেডিকেল অফিসার এবং কন্সাল্ট্যান্ট, ডাঃ বিনায়ক হিরেমাথ বলেন, টাইপ ১ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ওঠানামা করতে পারে, যা রক্তদানের ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতাকে প্রভাবিত করে। “এছাড়াও, ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিসের সাথে সম্পর্কিত জটিলতাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত কিছু ওষুধও একজন ব্যক্তির রক্তদান করার ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। অতএব, রক্তদান যেহেতু তাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে তাই তাদের সাধারণত রক্তদান করার পরামর্শ দেওয়া হয় না, “তিনি ব্যাখ্যা করেন।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস এবং রক্তদান
সাধারণত যেসব শিশু বা অল্প বয়স্কদের মধ্যে টাইপ ১ ডায়াবেটিস নির্ণয় করা হয় তাদের প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হয়। ডাঃ হিরেমাথ বলেন, “ব্লাড সুগারের লেভেল ওঠানামা করার এবং ব্লাড সুগার সম্পর্কিত অন্যান্য জটিলতার (যেমন রেটিনোপ্যাথি, নিউরোপ্যাথি, কার্ডিওভাসকুলার অবস্থা এবং সংক্রমণের সংবেদনশীলতা) কারণে, ব্লাড সুগার আছে এমন ব্যক্তিরা রক্তদান করার ক্ষেত্রে আরও বেশি বাধার সম্মুখীন হন।”
উপরন্তু, ডাঃ অনুপ ব্যাখ্যা করেন যে তাদের রক্তে ইনসুলিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে, যা তাত্ত্বিকভাবে প্রাপকের ব্লাড সুগারের মাত্রা কম করতে পারে। “আবার বলি, এক্ষেত্রে কোন শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তবে, সবকিছু নিরাপদ রাখার জন্য ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি আপনার টাইপ ১ ডায়াবেটিস থাকলে আপনার কাছ থেকে রক্ত নাও নিতে পারে,” তিনি বলেন।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস এবং রক্তদান
ডাঃ হিরেমাথ বলেন যে টাইপ ২ ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিদের সেটি কতটা গুরুতর এবং সেটির চিকিৎসা পরিকল্পনার উপর রক্তদান করার সীমাবদ্ধতা নির্ভর করে। “যদি তাদের শরীরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের সাথে অন্যান্য রোগ থাকে, তবে ৩৫০ থেকে ৪০০ মিলি রক্ত তাদের শরীর থেকে বের করে নিলে তা কখনও কখনও দাতার মধ্যে অস্থিরতা বা মাথা ঘোরার কারণ হতে পারে,” বলেন ডাঃ অনুপ।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন যে ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির প্রয়োজনীয়তাও চাহিদা এবং সরবরাহের উপর নির্ভর করে। “যদি কোনও এলাকায় একটি নির্দিষ্ট ব্লাড গ্রুপের ঘাটতি থাকে তবে তারা ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তির কাছ থেকেও রক্ত গ্রহণ করতে পারে। আর যদি সেই এলাকায় সেই ব্লাড গ্রুপ পর্যাপ্তরূপে উপলভ্য থাকে তবে তারা ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তির কাছ থেকে রক্ত নিতে অস্বীকার করতে পারে,” তিনি বলেন।
নির্দেশিকা কি বলে?
জাতীয় আইন এবং সংস্থাগুলি রক্তদানের জন্য নির্দিষ্ট যোগ্যতার মানদণ্ড প্রদান করে যাতে দাতা এবং গ্রহীতা উভয়ের শারীরিক সুস্থতাকে নিশ্চিত করা যায়। বিভিন্ন দেশ দ্বারা অনুসরণ করা কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশিকাকে অন্তর্ভুক্ত করা হল:
♦ ন্যাশনাল ব্লাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিল, ভারত
- ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিরা রক্ত দিতে পারেন যদি তাদের ডায়াবেটিস ডায়েটের দ্বারা বা ওষুধ খাওয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
- ইনসুলিন ব্যবহারকারীরা রক্ত দিতে পারেন না।
♦ আমেরিকান রেড ক্রস সোসাইটি
- যেসব ব্যক্তিদের ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ আছে যদি তাদের চিকিৎসা করা হয় এবং তাদের সেই অবস্থা যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে তবেই তারা কেবল রক্তদান করতে পারবে।
♦ NHS ব্লাড অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্ট, যুক্তরাজ্য
- ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিরা রক্তদান করতে পারেন যদি তাদের এই অবস্থাটি শুধুমাত্র ডায়েটের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বা যদি তারা একই ওষুধের একই ডোজ চার সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে গ্রহণ করে থাকে।
- কোনও ব্যক্তি নিয়মিত ইনসুলিন নিলে বা গত চার সপ্তাহের মধ্যে ইনসুলিন নিয়ে থাকলে রক্তদান করতে পারে না।
- যদি কোনও ব্যক্তির হৃদরোগের সাথে অন্যান্য কোনও রোগ থাকে তাহলে সেইসব ব্যক্তিরা রক্তদান করতে পারবে না।
সারসংক্ষেপ
- ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিদের কাছে রক্তদান করার কাজটি কঠিন বলে মনে হতে পারে, কারণ অনেক ব্লাড ব্যাঙ্ক তাদের রক্ত গ্রহণ করতে নাও করতে পারে। তবে, যাদের ব্লাড সুগারের মাত্রা সুনিয়ন্ত্রিত তারা রক্তদান করতে পারে, যদি তারা প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে, বিশেষজ্ঞরা বলেন।
- ডায়াবেটিসের সাথে থাকা অন্যান্য রোগকে নিয়ন্ত্রণকারী কিছু ওষুধ একজন ব্যক্তির রক্তদানের ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
- ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির রক্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও রক্তের চাহিদা এবং সরবরাহের উপর নির্ভর করে। কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে কোনও নির্দিষ্ট ব্লাড গ্রুপের ঘাটতি থাকলে তারা ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তির কাছ থেকেও রক্ত নিতে পারে।
- ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিদের হাইপোগ্লাইসেমিয়ার মতো জটিলতা প্রতিরোধ করতে রক্তদান করার আগে ও পরে তাদের ব্লাড গ্লুকোজের লেভেলকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এছাড়াও, তাদের পর্যাপ্ত বিশ্রামও নেওয়া উচিত এবং ইনজেকশন নেওয়ার জায়গাগুলিতে যেন সংক্রমণ না হয় সেক্ষেত্রে নজর রাখতে হবে।