ডায়াবেটিস খুব নির্মম হতে পারে। শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের পাশাপাশি, এটি নবজাতকদেরও হতে পারে। নবজাতকদের হওয়া ডায়াবেটিসকে নিওনেটাল ডায়াবেটিস বলা হয়, যা শিশুর জন্মের ছয় মাসের মধ্যে নির্ণয় করা হয়। জেনেটিক মিউটেশনের কারণে, এই ধরণের ঘটনা প্রায় ১০০,০০০ থেকে ৪০০,০০০ জীবিত শিশুর মধ্যে প্রায় একটিতে দেখতে পাওয়া যায়, বলেন USA-এর ক্লিভল্যান্ডের UH রেইনবো বেবিস অ্যান্ড চিলড্রেন’স হসপিটালের পেডিয়াট্রিক এন্ডোক্রিনোলজিস্ট, ডাঃ ক্যাসনিয়া টনিউশকিনা
নিওনেটাল ডায়াবেটিস হওয়ার কারণ কী?
ডাঃ টোনিউশকিনা বলেন, নিওনেটাল ডায়াবেটিস বলতে অগ্ন্যাশয়ের বিকাশের সময় ত্রুটির কারণে জীবনের প্রথম ১২ মাসের মধ্যে ডায়াবেটিস বা রক্ত ও প্রস্রাবের গ্লুকোজের উচ্চমাত্রার প্রাথমিক সূত্রপাতকে বোঝায়। “এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্ন্যাশয়ের বিটা সেলের বিকাশ এবং কার্যকারিতাকে প্রভাবিতকারী জিনের এক অপ্রত্যাশিত মিউটেশনের কারণে ঘটে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, মায়ের রক্তে গ্লুকোজের সমস্যা বা ডায়াবেটিস থাকে না, “তিনি বলেন।
বেঙ্গালুরুর মারাঠাহাল্লির রেইনবো চিলড্রেন’স হসপিটালের নিওনাটোলজি এবং পেডিয়াট্রিক্সের কনসালট্যান্ট, ডাঃ সন্দীপ আর বলেন, যদিও নিওনেটাল ডায়াবেটিস জীবনের প্রথম মাসেই দেখা দিলেও, ছয় মাস বয়সের শেষের দিকে এটিকে নির্ণয় করা যায়।
নিওনেটাল ডায়াবেটিস আছে এমন অনেক শিশু প্রিটার্ম বা সম্পূর্ণ গর্ভধারণ কাল পূরণ করার আগেই জন্ম নেয়। “প্রিটার্ম বাচ্চাদের নিরীক্ষণের জন্য NICU [নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট]-এ রাখা হয় এবং এই ধরনের ক্ষেত্রে, আমরা নিয়মিত তাদের ব্লাড সুগার নিরীক্ষণ করলে দ্রুত রোগ নির্ণয় করা হয়। যদি তাদের ব্লাড সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে আমরা তাদের নিওনেটাল ডায়াবেটিস আছে বলে সন্দেহ করি,” বলেন ডঃ সন্দীপ।
নবজাতকের মধ্যে ডায়াবেটিসের লক্ষণ
ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাওয়া ব্লাড গ্লুকোজের মাত্রার (>২০০ mg/dl) অন্যান্য কারণগুলিকে বাতিল করার পরে নিওনেটাল ডায়াবেটিস নির্ণয় করা হয়। “যখন জেনেটিক টেস্টিং দ্বারা একটি কার্যকারক জিন মিউটেশনকে শনাক্ত করে তখন রোগ নির্ণয় নিশ্চিত হয়,” বলেন ডাঃ টনিউশকিনা।
ডাঃ সন্দীপ আরও বলেন যে স্বাভাবিক লক্ষণগুলির মধ্যে একটি হল উন্নতি করতে না পারা, যেখানে ভালভাবে পেটপুরে খাওয়ানো সত্ত্বেও শিশুর ওজন বাড়ে না। এই লক্ষণগুলি সাধারণত হাসপাতাল থেকে তাদের ছেড়ে দেওয়ার পরে দেখতে পাওয়া যায়। “আক্রান্ত শিশুর প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের IUGR (ইন্ট্রাইউটেরাইন গ্রোথ রেস্ট্রিকশন বা গর্ভে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত) আছে। ফলস্বরূপ, তাদের জন্মের সময় তাদের ওজন কম হয়েছে এবং তারা অপুষ্ট থেকেছে,” তিনি বলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিওনেটাল ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ডায়াবেটিস কিটোঅ্যাসিডোসিস (রক্তে অ্যাসিড তৈরি হওয়া)।
- বৃদ্ধি এবং বিকশ ব্যহত হওয়া
- ঘন ঘন প্রস্রাব করা এবং তেষ্টা পাওয়া
- জলবিয়োজন
নিওনেটাল ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিওনেটাল ডায়াবেটিস সাময়িক বা স্থায়ী হতে পারে। ক্লিনিকাল উপস্থাপনা এবং পূর্বাভাসের উপর ভিত্তি করে, এটিকে চার প্রকারে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে:
♦ ক্ষণস্থায়ী নিওনেটাল ডায়াবেটিস
নিওনেটাল ডায়াবেটিসের প্রায় ২০ শতাংশ ঘটনাগুলি ক্ষণস্থায়ী। এটি স্থায়ী নয়, এবং শিশুদের ১৩ সপ্তাহ থেকে দেড় বছর বয়সের মধ্যে এটি সেরে যায়। তবে, কেউ কেউ কৈশোর বা যৌবনকালে অন্যান্য ধরণের ডায়াবেটিস বিকশিত করতে পারে।
♦ সালফোনিলুরিয়া–রেস্পনসিভ নিওনেটাল ডায়াবেটিস
এটি নিওনেটাল ডায়াবেটিসের সবচেয়ে সাধারণ রূপ, যা প্রায় ৪০ শতাংশ ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে দায়ী, ডাঃ টনিউশকিনা বলেন। শিশুদের ইনসুলিন নিঃসরণকে উন্নত করতে সাহায্যকারী ওষুধ খাওয়ানো হলে তাতে তারা ভাল সাড়া দেয়। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের আজীবন ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।
♦ ইনসুলিন–ডিপেন্ডেন্ট নিওনেটাল ডায়াবেটিস
এগুলি সমস্ত ঘটনাগুলির প্রায় ১০ শতাংশ নিয়ে গঠিত এবং এক্ষেত্রে স্থায়ী ইনসুলিন থেরাপির প্রয়োজন হয়।
♦ নিওনেটাল ডায়াবেটিস জেনেটিক সিনড্রোমের সাথে সংযুক্ত
আনুমানিক ১০ শতাংশ ঘটনাগুলিতে অন্যান্য সিনড্রোমের অংশ হিসাবে উপসর্গ দেখা যায়। তাদের সাধারণত হাইপারগ্লাইসেমিয়া ছাড়াও একাধিক অঙ্গে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ত্রুটি থাকে।
নিওনেটাল ডায়াবেটিসের জটিলতা
নিওনেটাল ডায়াবেটিসের জটিলতাগুলির মধ্যে সাধারণত বিকাশে বিলম্ব, শেখার অক্ষমতা, পেশীর দুর্বলতা এবং জন্মের সময় ওজন কম হওয়ার বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত। “জটিলতাগুলি অন্যান্য ধরণের ডায়াবেটিসের মতো (টাইপ ১ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস মেলিটাস), যার মধ্যে রয়েছে কার্ডিওভাসকুলার জটিলতার বর্ধিত ঝুঁকির সাথে রেটিনা, কিডনি আর পায়ের ছোট ও বড় রক্তনালীগুলির ক্ষতি,”ড. টনিউশকিনা আরও বলেন।
এছাড়াও, নিওনেটাল ডায়াবেটিস আছে এমন শিশুদেরও কিটোঅ্যাসিডোসিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, যে অবস্থাটিকে হঠাৎ করে ব্লাড সুগার বৃদ্ধি পাওয়া, অ্যাসিডোসিস (শরীরে অ্যাসিড তৈরি হওয়া) এবং মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এইসব লক্ষণগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইনসুলিন ইনফিউশনের প্রয়োজন হয়।
এই অবস্থাটি শিশুদের এবং তাদের পরিবারের জীবনযাত্রার মানকেও প্রভাবিত করে। বাচ্চাদেরও পরবর্তী জীবনে টাইপ ১ ডায়াবেটিস বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। নিওনেটাল ডায়াবেটিস প্রাথমিকভাবে ওষুধ বা ইনসুলিন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, কারণ শিশুরা তখন শুধুমাত্র বুকের দুধ পান করে। তবে, যখন তারা শক্ত খাবার খাওয়া এবং স্কুলে যাওয়া শুরু করে তখন এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে, ডঃ সন্দীপ বলেন। “আমরা সাধারণত অভিভাবকদের তাদের বাচ্চাদের খাবারের ব্যাপারে খুব একটা বেশি কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিই না এবং তাদেরকে প্রায় সবকিছুই খেতে দিতে বলি, তবে পরিমিত পরিমাণে। কিন্তু আমরা তাদের সন্তানের ইনসুলিনের ডোজকে সেই অনুযায়ী সামঞ্জস্য করার পরামর্শ দিই,” তিনি ব্যাখ্যা করেন।
তাই, পরিবারগুলিকে অবশ্যই শিশুদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে, নিশ্চিতরূপে নিয়মিত ফলোআপ করতে হবে এবং মস্তিষ্কের বিকাশ করার সময়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার হওয়ার কোনও ঘটনা এড়াতে তাদের ইনসুলিন এবং অন্যান্য ওষুধের সঠিক ডোজ (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী) দিতে হবে। “প্রতিটি হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার ঘটনা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে, অভিভাবককে সঠিকভাবে শিক্ষা প্রদানের দ্বারা এই অবস্থাটি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, “তিনি বলেন।
সারসংক্ষেপ
- নিওনেটাল ডায়াবেটিস এমন একটি অবস্থা যাতে নবজাতকদের ব্লাড সুগারের মাত্রা বেশি থাকে। এটি সাধারণত ছয় মাস বয়সে নির্ণয় করা হয়।
- এর লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে বৃদ্ধি এবং বিকাশ ব্যহত হওয়া, কিটোঅ্যাসিডোসিস হওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব করা, তেষ্টা পাওয়া, এবং জলশূন্যতা।
- যাদের নিওনেটাল ডায়াবেটিস আছে তাদের পরবর্তী জীবনে টাইপ ১ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
- পরিবারগুলির নিয়মিত শিশুর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং সেই অনুযায়ী ইনসুলিনের ডোজ সামঞ্জস্য করা উচিত।