বাচ্চাদের জন্য স্বাস্থ্যকর একটি লাঞ্চ বক্স তৈরি করা বাবা–মায়ের কাছে সবচাইতে কঠিন কাজগুলির মধ্যে একটি। জাঙ্ক ফুড নয় এমন স্ন্যাক প্যাক করার সময় মনের মধ্যে থাকা দ্বিধা আরও বাড়তে থাকে। এইসব ক্ষেত্রে, খাদ্য উপাদানগুলির নিউট্রিশনাল ভ্যালু জানা থাকলে তা এই কাজটিকে সহজ করে তুলতে পারে। শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা জন্য তাদেরকে জাঙ্ক ফুড থেকে দূরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, যার ফলে তাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়, বিশেষজ্ঞরা বলেন।
বাচ্চাদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার
হ্যাপিয়েস্ট হেলথ দ্বারা আয়োজিত দ্য এজ অফ নিউট্রিশন সামিট–এ শিশু পুষ্টি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে, বেঙ্গালুরুর ধী হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্ভিসের ডিরেক্টর, সিনিয়র পেডিয়াট্রিশিয়ান এবং ইনটেনসিভিস্ট ডক্টর সুপ্রজা চন্দ্রশেখর বলেন, “কোনটিকে স্বাস্থ্যকর খাবার বলা হয় আর কোনটিকে অস্বাস্থ্যকর বা জাঙ্ক ফুড বলা হয় তা বাবা–মায়েদের জানা গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন এবং মিনারেল আছে এমন যেকোনও খাবার শিশুদের জন্য ভালো। অন্যদিকে, অতিরিক্ত নুন, চিনি, প্রিজারভেটিভ এবং চর্বিযুক্ত খাবারগুলিকে জাঙ্ক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পিতামাতারা যদি খাবারের নিউট্রিশনাল ভ্যালু সম্পর্কে সচেতন হন তাহলে তাদের পক্ষে সঠিক খাবার নির্বাচন করা সহজ হয়ে যায়।”
পুষ্টি বা নিউট্রিশনের কালার কোড
শিশুদের মধ্যে সাধারণত লোহা, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি ১২, জিঙ্ক এবং ক্যালসিয়ামের মতো পুষ্টির ঘাটতি দেখা যায়, যা ইমিউনিটি বা অনাক্রম্যতাকে দুর্বল করে তোলে এবং তাদের অ্যালার্জি, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অল্পবয়সে বয়ঃসন্ধির ক্ষেত্রে সংবেদনশীল করে তোলে, ডাঃ চন্দ্রশেখর বলেন।
“সমস্ত গাঢ় রঙের (বিশেষত সবুজ, লাল এবং বাদামী রঙের) খাবার যেমন শুঁটি, মাংস এবং বাদাম আয়রনের সমৃদ্ধ উৎস এবং শিশুদের সর্বোত্তম স্বাস্থ্য লাভ করার জন্য তাদেরকে এই জাতীয় খাদ্য উপাদানগুলিকে খেতে শেখানো উচিত,” তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, শিশুদের অবশ্যই সাদা রঙের খাদ্য উপাদানগুলি, যেমন নুন, চিনি,ময়দা এবং সাদা ভাত এড়িয়ে চলতে হবে।
এছাড়াও, শিশুদের খাওয়া এবং খেলার অভ্যাসগুলি অভিভাবকদের কাছে প্রধান উদ্বেগের বিষয়, ডঃ চন্দ্রশেখর বলেন। “স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য খাওয়া–দাওয়া করার পরিবেশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক একটি কাঠামো এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ এক রুটিন তাদের সুস্থতার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। বাচ্চাদের তাদের পরিবার এবং প্রকৃতির সাথে ভালভাবে সময় কাটানো উচিত, কারণ টিভি এবং কম্পিউটারের জন্য অতিবাহিত সময় বাড়ার ফলে তাদের অলস জীবনধারা গড়ে ওঠে সাথে জাঙ্ক ফুডের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়, যা তাদের মোটা করে তুলতে পারে,” তিনি আরও বলেন।
একজন শিশুর জন্য আদর্শ খাবারের থালা
ডঃ চন্দ্রশেখর শিশুদের প্রয়োজনীয় পুষ্টিলাভ করার বিষয়টিকে নিশ্চিত করার জন্য সঠিক অনুপাতে সঠিক ধরণের খাবার দেওয়ার গুরুত্বের উপর জোর দেন। তাঁর মতে, ব্যালান্সড ডায়েট বা সুষম খাদ্যে এই খাবারগুলি থাকা উচিত:
- প্লেটের এক চতুর্থাংশ হোল গ্রেনস এবং বাজরা থাকা উচিত।
- প্লেটের এক চতুর্থাংশ প্রোটিন, যেমন ডাল, বিনস, সয়া, বাদাম, বীজ, মাংস, ডিম, মুরগির মাংস এবং মাছ। চর্বিহীন প্রোটিনকে বেছে নেওয়াই ভালো।
- প্লেটের এক চতুর্থাংশ সবজি, যার মধ্যে পাঁচ ধরনের, যেমন সবুজ, স্টার্চি, লাল–কমলা, বিনস এবং অন্যান্য সমস্ত শাক–সবজি রয়েছে। শিশুদের সব ধরনের মাইক্রো–নিউট্রিয়েন্ট পাওয়ার জন্য তাদের এই সবজিগুলিকে নিয়মিতভাবে পরিবর্তন করে খাওয়ানো উচিত।
- প্লেটের এক চতুর্থাংশ ফল। জুসের চেয়ে পুরো ফল বা স্মুদি বেছে নেওয়াই ভালো।
- এক কাপ যেকোনও দুগ্ধজাত পণ্য। তাজা, বাড়িতে তৈরি খাদ্যদ্রব্য সর্বোত্তম স্বাস্থ্য লাভ করার জন্য আদর্শ।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন যে যে কোনও খাদ্যদ্রব্য বা ফুড আইটেম (তা সে ভারতীয় হোক বা পাশ্চাত্যের হোক না কেন) দিয়ে হেলদি ডিশ তৈরি করা যেতে পারে যদি তাতে সমস্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকে। তিনি বলেন, “কোনো প্রিজারভেটিভ ছাড়া এবং হোল গ্রেন ক্রাস্ট দিয়ে বাড়িতে তৈরি পিৎজা বাইরের কম নিউট্রিশনাল ভ্যালু থাকা কচুরী ও আলুর দমের তুলনায় স্বাস্থ্যকর খাবার“।
শিশুদের পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা
একজন শিশুর এমন একটি ডায়েট থাকা উচিত যা বৈচিত্রময় এবং যাতে বিভিন্ন রঙের ফল ও শাক–সবজি থাকে, বেঙ্গালুরুর সেন্ট জনস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পুষ্টি বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রধান, ডাঃ রেবেকা কে রাজ বলেন। “সব ধরনের মাইক্রো–নিউট্রিয়েন্ট পেতে শিশুদের অবশ্যই রামধনুর মতো ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের ফল ও শাকসবজি খেতে হবে। কার্বোহাইড্রেটের অত্যধিক ব্যবহার এড়িয়ে চলতে তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন এবং চর্বি খাওয়া উচিত, “তিনি আরও বলেন।
এছাড়াও, ডাঃ রাজ জোর দিয়ে বলেন যে একজন শিশুকে দিনে প্রায় দুই থেকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফল খেতে দিতে হবে। “একজন প্রাপ্তবয়স্কের মতোই, একজন শিশুরও প্রতিদিন আধ কেজি ফল ও শাক-সবজির প্রয়োজন হয়। সেটি শুধুমাত্র প্রাতঃরাশ খাওয়ার সময়েই খেতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা না রেখে সারা দিনে যে কোনও সময় তা খেতে দেওয়া যেতে পারে,” তিনি বলেন।
বেঙ্গালুরুর অ্যাপোলো হসপিটালের চিফ ডায়াটেশিয়ান, ডাঃ প্রিয়াঙ্কা রোহাতগি, বলেন যে ‘৫৩২১০‘ নীতি অনুসরণ করা পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং এক স্বাস্থ্যকর জীবনধারা নিশ্চিত করে৷ এই ধারণা অনুযায়ী, একজন শিশুর দৈনন্দিন রুটিনে রাখা উচিত:
- ৫ বার ফল এবং সবজি খাওয়া।
- ৩ বার সুষম খাবার খাওয়া।
- টিভি ও কম্পিউটারের জন্য বরাদ্দ ২ ঘন্টা।
- ১ ঘন্টা শারীরিক কার্যকলাপ বা ব্যায়াম করা।
- জাঙ্ক এবং HFSS (অত্যধিক চর্বি, নুন এবং চিনি যুক্ত) খাবার একদম ০ পর্যায়ে আনতে হবে।
বাচ্চাদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা
ডঃ রোহাতগি বলেন, শিশুদের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তাদের তাড়াতাড়ি খিদে পাওয়ার মাত্রাকে পরিমাপ করতে পারার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। “বাবা–মা হিসেবে আমাদের রোল মডেল হতে হবে এবং আমরা মুখে যা বলি তা কাজে করে দেখাতে হবে। শিশুরা যেন সুস্বাদু ও তৃপ্তিদায়ক স্বাস্থ্যকর খাবার খায় তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। অভিভাবকদের খাবারকে পুরস্কার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয় এবং বাচ্চাদের সময়মতো খাবার দেওয়ার বিষয়টিকে নিশ্চিত করা উচিত,” তিনি আরও বলেন।
রেস্তোঁরায় খাওয়ার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে, ডাঃ রোহাতগি বলেন পোর্শন কন্ট্রোল এবং সক্রিয় জীবনধারা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ, তিনি সতর্ক করেন যে নিয়মিত বাইরে খাওয়া শিশুদের মোটা হওয়ার কারণ হতে পারে।
সারসংক্ষেপ
- পিতামাতাদের তাদের সন্তানদের সঠিক পুষ্টি প্রদান করার জন্য খাদ্যদ্রব্যের নিউট্রিশনাল ভ্যালু জানতে হবে।
- বাচ্চাদের অবশ্যই প্রকৃতি এবং তাদের পরিবারের সাথে ভালভাবে সময় কাটাতে হবে, কারণ স্ক্রিন টাইম বাড়ানোর কারণে তারা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া পছন্দ করতে পারে, যা অবশেষে তাদেরকে মোটা করে তুলতে পারে।
- একজন শিশুর প্রতিদিন আধ কেজি ফল ও শাক–সবজির প্রয়োজন হয়, যা সারাদিনে তাকে দেওয়া যেতে পারে।
- ডায়েট থেকে সমস্ত প্রয়োজনীয় মাইক্রো–নিউট্রিয়েন্ট পেতে শিশুদের অবশ্যই রামধনুর মতো ভিন্ন ভিন্ন রঙের ফল এবং শাকসবজি খেতে হবে।