শিশুদের নাক দিয়ে রক্তপাত হলে একটা সাধারণ ভুল সবাই করে থাকেন । সেটা হল রক্তপাত বন্ধ করার জন্য তাদের পিছনের দিকে মাথা হেলিয়ে দিতে বলেন।
কর্ণাটকের মাইসুরুর গৃহবধূ মনিকা কার্তিক বলেন, যতক্ষণ না তাঁর শিশু চিকিৎসক তাঁকে শুধরে দিয়েছিলেন ততক্ষণ একই ভুল তিনি তাঁর পাঁচবছরের সন্তানের সাথে প্রায় এক বছর ধরে করে এসেছিলেন।
“প্রথমবার আমার সন্তানের নাক দিয়ে রক্তপাত হতে দেখে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম,” তিনি বলেন। “আমি ওর নাক চেপে ধরি আর রক্ত বন্ধ করার জন্য আমি ওর মাথাকে পিছনের দিকে হেলিয়ে দিই, কিন্তু রক্ত বন্ধ হতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল”।
নাক দিয়ে রক্ত পড়া বা এপিসট্যাক্সিস (epistaxis) হল এইরকম এক অবস্থা যেখানে হঠাৎ করে নাক দিয়ে আপনা আপনি রক্ত পড়া শুরু হয়ে যায়। এটা নাকের একটা ছিদ্র দিয়েও হতে পারে আবার দুটি ছিদ্র দিয়েও হতেও পারে।
নাক দিয়ে রক্ত পড়া কীভাবে বন্ধ করা যায়?
বাল্টিমোরের মেরিল্যান্ড স্কুল অব মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমার্জেন্সি ডাক্তার ও ফ্যাকাল্টি মেম্বার ডঃ এলিজাবেথ ক্লেবোর্ন, সিইও ও নাসাক্লিপ–এর প্রতিষ্ঠাতা। তার মতে অভিভাবক ও পরিচর্যাকারীরা একটা ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করেন। “ তারা প্রায়শই তাদের সন্তানদের নাক দিয়ে রক্তপড়া নিয়ন্ত্রণ করতে অকৃতকার্য হন। কারণ তারা নাকের ভুল জায়গা টিপে ধরেন, সামনের দিকে ঝোঁকার পরিবর্তে মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে দেন অথবা সঠিক সময় চাপ দিয়ে ধরে রাখতে পারেন না,” তিনি বলেন।
তার সাথে সহমত হয়ে বেঙ্গালুরুর মনিপাল হাসপাতালের কনসালটেন্ট পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভিষ্ট ডঃ সুপ্রজা চন্দ্রশেখর বলেন যে, যখন থুতনিকে উপর দিকে তুলে ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তখন রক্ত আবার নাকের ভিতরে চলে যায়, সেখান থেকে গলায় চলে যায়, যার কারণে দমবন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ডঃ ক্লেবোর্নের মতে, বাড়িতে যদি কোনো শিশুর রক্তপাত হয়, তাহলে প্রথম পদক্ষেপ হল তাদের নাকে জমাটবাঁধা রক্ত বের করে পরিষ্কার করা।“অভিভাবকরা নোজ–কনজেশন স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন, যেটি ডাক্তাররা শুধুমাত্র ছয় বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য সুপারিশ করেন,” তিনি বলেন৷ “কমপক্ষে ১০ মিনিটের জন্য নাকের উপর অবিরাম চাপ দিয়ে ধরে রাখুন । অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানের নাকের হাড় যেখানে শেষ হয়েছে তার নীচে নাকের নরম দুই পাশে আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরা। চাপটা দৃঢ় হওয়া দরকার, যেটা কারোর পক্ষে নিজের বাচ্চার উপর প্রয়োগ করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে কিন্তু, সঠিকভাবে করলে নাক দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে”।
হরিয়ানার ফরিদাবাদের অমৃতা হাসপাতালের ইএনটি বিভাগের প্রধান ডঃ নীরজ নারায়ন মাথুর বলেন যে, যদি রক্ত পড়া বন্ধ না হয়, তাহলে অভিভাবকরা আইসপ্যাক অথবা একটা রুমালের মধ্যে একটা বরফের টুকরো নিয়ে নাকের উপরিভাগের হাড়ের উপরে চেপে ধরতে পারেন । তিনি বলেন যদি এতেও কাজ না হয় তাহলে শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার।
নাক দিয়ে রক্ত পড়া গুরুতর ব্যাপার নয়
নাক থেকে রক্ত পড়া উদ্বেগজনক হতে পারে, কিন্তু সাধারণত সেগুলি গুরুতর নয়, ডাঃ ক্লেবোর্ন বলেন।
“প্রায় ৬০ শতাংশ লোকের জীবনে অন্তত একবার হলেও নাক দিয়ে রক্তপাত হবে,” তিনি বলেন । দুই থেকে ১০ বছর বয়সী শিশু এবং ৫৫ থেকে ৮০ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশী । নাক দিয়ে রক্ত পড়া, রক্তের ব্যাধি, উচ্চরক্তচাপ বা যারা রক্ত পাতলা করার ওষুধ গ্রহণ করেন তাদের মধ্যেও খুব সাধারণ”।
নাক দিয়ে রক্তপাতের ধরন
ডাঃ ক্লেবোর্ন, যিনি আমেরিকান কলেজ অফ ইমার্জেন্সি ফিজিশিয়ানস–এর সদস্য বলেছেন, নাক দিয়ে রক্ত পড়ার দুটি ধরন আছে:
- বেশিরভাগ নাক দিয়ে রক্তপাত হয় সামনের দিকে।এতে, শ্লেষ্মা, পাতলা ঝিল্লি যা নাসিকা গহ্বর পথের অভ্যন্তরে রয়েছে, সেগুলি ক্ষয় হয়ে যায় এবং রক্তবাহগুলি উন্মুক্ত হয়ে যায় । তখন সেগুলি ভেঙে যায়, যার ফলে নাকের সামনের অংশে রক্তপাত হয়।
- নাকের ভিতর দিকের রক্তপাত একটি আপৎকালীন অবস্থা। যার সাথে রয়েছে পাম্পিং এবং ধমনি থেকে প্রচুর রক্তপাত । এটি নাকের আরও ভিতরের অংশ থেকে আসে।
নাক দিয়ে রক্তপাত কেন হয়?
ডঃ মাথুর বলেন, প্রধানত স্কুলগামী শিশুদের এবং কমআর্দ্রতা সহ ঋতুতে যেমন প্রচন্ড শীতে বা প্রচন্ড গরমে নাক দিয়ে রক্তপাত হয়। “নাক দিয়ে রক্তপাত হয় সেপ্টামের পূর্ববর্তী অংশ থেকে (নাকের ছিদ্রের মধ্যবর্তী এলাকা), যাকে লিটলস এরিয়া বলা হয় । আর ৯৯.৯ শতাংশ নাক দিয়ে রক্তপাতের চিকিৎসা সহজেই বাড়িতে করা যায়,” তিনি বলেন । ওনার মতে, নাকের ময়লা পরিষ্কার করার সময় কখনও কখনও আঙ্গুলের নখের আঁচড়ের কারণ হতে পারে, যা শিশুদের মধ্যে রক্তপাতের কারণ হতে পারে।
আবহাওয়ার পরিবর্তনও একটা কারণ হিসেবে কাজ করে, বলেন ডঃ ক্লেবর্ন। “শীতের প্রাক্কালে এবং সারা শীত ধরে নাকের সামনের অংশ দিয়ে রক্তপাত হওয়া খুব সাধারণ”, তিনি বলেন। “যেহেতু বাতাস অনেক ঠান্ডা এবং আর্দ্র হয়ে যায় আর মানুষজন ঘরের গরমের মধ্যে থাকেন, তাই সেটি নাক আরও শুকিয়ে যাবার কারণ হতে পারে। যার কারণে নাক দিয়ে রক্তপাত হয়। সিজনাল অ্যালার্জি এই সময়ের সাথে জুড়ে যায় যা নাকের মিউকোসাকে উত্তেজিতও করে। ‘নাক দিয়ে রক্তপাতের সিজন’-এর চরম সময়ে কোনও ব্যক্তির সপ্তাহে একবার নাক দিয়ে রক্তপাত হওয়া অথবা একমাসে তিন চারবার নাক দিয়ে রক্তপাতের চিকিৎসাও অস্বাভাবিক নয়”।
ডাঃ মাথুরের মতে, প্রাপ্তবয়স্কদের এবং বয়স্কব্যক্তিদের মধ্যে, উচ্চরক্তচাপ বা ভঙ্গুর রক্তবাহর কারণে নাকের ভিতরের দিকে রক্তপাত দেখা যায়, তাই যখন সামান্য টেনশন হয়, তখন রক্তবাহ ফেটে রক্তপাত শুরু হয়।
আপনার কখন চিন্তিত হওয়া উচিত?
শুধুমাত্র একদিক থেকে অবিরাম নাক দিয়ে রক্তপাত হলে এবং তার সাথে দুর্গন্ধ থাকলে মা-বাবাদের অবশ্যই তাদের শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে কারণ নাকের ভেতর কোনও একটি বাইরের জিনিস থাকতে পারে যা শিশুটি নিজের মা-বাবার অজান্তেই নিজের নাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে, ডাঃ চন্দ্রশেখর বলেন।
বারবার নাক দিয়ে রক্ত পড়া, রক্তের ব্যাধি বা অন্য সমস্যার সাথে জড়িত থাকতে পারে আর তাই একজন ডাক্তারের সাথে অবশ্যই পরামর্শ করতে হবে, ডাঃ ক্লেবোর্ন বলেন।
সারসংক্ষেপ
শিশুদের মধ্যে নাক দিয়ে রক্তপাত প্রতিরোধ করার জন্য অভিভাবকগণ নিম্নলিখিত কাজগুলি করতে পারেনঃ
- শিশুদের নখ কাটুন এবং তাদেরকে নাক খোটা এড়িয়ে চলতে শেখান।
- জল দিয়ে নাক পরিষ্কার করুন; যদি ময়লা বেশি জমে থাকে তাহলে স্যালাইন ওয়াটার ব্যবহার করা যেতে পারেন ।
- বারবার রক্তপাত হলে আপনার শিশুকে একজন ইএনটি বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করান।
- নাসিকা গহ্বরের পথের মিউকোসাকে আর্দ্র রাখার জন্য শিশুর ঘরে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন অথবা নাকে স্যালাইন স্প্রে করুন। এটি নাক দিয়ে রক্তপাতের ঝুঁকিকে কমাতে সাহায্য করতে পারে।