গরমে ত্বকের যত্ন নিতে অবশ্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। এককথায়, সানস্ক্রিন হল একজনের ত্বকের যত্নের রুটিনের একটি অপরিহার্য উপাদান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সুপারিশ করছে যে, সাধারণত মানুষজন ব্রড-স্পেকট্রাম সানস্ক্রিন প্রয়োগ করে, যার মধ্যে রয়েছে SPF 15+ (সান প্রোটেকশন ফ্যাক্টর) সানস্ক্রিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সমস্ত মানুষকে ক্রমাগত সূর্যের এক্সপোজ়ারের মধ্যে থাকতে হয়, তাঁদের প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর এই ধরনের সানস্ক্রিন প্রয়োগ করা উচিত।
পুদুচেরির ডাঃ জুডস হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট অ্যান্ড স্কিন ক্লিনিকের মূল পরামর্শক এবং চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জুড দিলীপ বলেছেন, “সানস্ক্রিন ট্যানিং, ত্বকের শিথিলতা, বলিরেখা, নিস্তেজ বর্ণ, অসম ত্বক এবং ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এটি ব্রণ, রোসেসিয়া এবং ফটো অ্যালার্জির মতো আলোক সংবেদনশীল ত্বকের অবস্থার মানুষজনের জন্যও চিকিৎসা পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গঠন করে।”
বাজারে বিভিন্ন ধরনের সানস্ক্রিন পাওয়া যায়। সেই সঙ্গেই আবার টিভির পর্দা থেকে শুরু করে আজকের নেটমাধ্যমেও সানস্ক্রিনের বাহারি বিজ্ঞাপনে ছড়াছড়ি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এত কিছুর মাঝে মানুষ একপ্রকার বিভ্রান্ত হয়ে যান, কোন সানস্ক্রিন তাঁর ত্বকের জন্য ভাল? গরমকালে প্রখর রৌদ্রতাপ থেকে বাঁচতে কোন সানস্ক্রিন বেছে নেওয়া উচিত? বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরনের সানস্ক্রিন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানালেন হ্যাপিয়েস্ট হেলথের কাছে।
ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিন
ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিন, যা মিনারেল/ইনর্গ্যানিক সানস্ক্রিন নামেও পরিচিত, ত্বক এবং ক্ষতিকারক UV রশ্মির মধ্যে একটি ঢাল হিসাবে কাজ করে এবং সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে ত্বকের ক্ষতি করা থেকে আটকাতে পারে বলে জানালেন বেঙ্গালুরুর চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এবং কসমেটোলজিস্ট ডাঃ শোবা সুদীপ।
ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিনের সাধারণ উপাদান
* জিঙ্ক অক্সাইড
* টাইটানিয়াম ডাইঅক্সাইড
ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিনে এই উপাদানগুলি প্রাকৃতিক ভাবে কাজ করার ফলে এগুলি রাসায়নিক উপাদানগুলির চেয়ে নিরাপদ বলে মনে করা হয়। ডাঃ জুড দিলীপ এবং ডাঃ শোবা সুদীপ ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিন ব্যবহারের বেশ কিছু সুবিধা ও অসুবিধার কথাও জানালেন।
ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিন ব্যবহারের সুবিধা
* জিঙ্ক অক্সাইড অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি সুবিধা দেয়। তাই এটি সংবেদনশীল ব্রণ-প্রবণ ত্বকে ব্যবহার করা অনেক বেশি নিরাপদ।
* এগুলি সব বয়সের এবং সমস্ত ধরনের ত্বকের সঙ্গে মানানসই। শিশুদের, গর্ভবতী মহিলাদের এবং রোসেসিয়া ও মেলাজমা আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এমনতর সানস্ক্রিন সুপারিশ করা হয়।
* সানস্ক্রিনগুলি ক্ষতিকারক রশ্মি প্রতিফলিত করে এবং মুখে মাখার সঙ্গে-সঙ্গে অবিলম্বে কাজ করে।
ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিন ব্যবহারের অসুবিধা
* এই সানস্ক্রিনগুলি ঘন হওয়ার ফলে সহজে ছড়ানো যায় না এবং প্রয়োগ করা কঠিন। ক্রিমগুলি একটি সাদা কাস্ট সাদাটে ভাব রেখে যায়, যা কসমেটিক ভাবে অপার্থিব। রাসায়নিক সানস্ক্রিনের তুলনায় ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিনগুলি ত্বকে কিছুটা ভারী বোধ করায়।
* ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিনগুলি জল প্রতিরোধী নয়। তাই, জলে থাকার সময় তারা কম সুরক্ষা দেয়।
ডাঃ জুড দিলীপ বলছেন, “হালফিলের নতুন ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিনগুলিতে ন্যানো পার্টিকেল থাকে, যা খুব একটা সাদাটে ভাব রেখে যায় না এবং কসমেটিক ভাবেও গ্রহণযোগ্য।” তবে ত্বকে ন্যানো পার্টিকেলগুলির অনুপ্রবেশ এবং পদ্ধতিগত শোষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিছু চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ আবার গর্ভবতী এবং বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের জন্য ন্যানো পার্টিকেল ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিনের সুপারিশ করেন না।
কেমিক্যাল সানস্ক্রিন
একটি কেমিক্যাল (রাসায়নিক) বা জৈব (অর্গ্যানিক) সানস্ক্রিনে ফিল্টার নামক অণু থাকে, যা অতিবেগুনি (UV) বিকিরণ শোষণ করে এবং নিরপেক্ষ করে। যেমন, এই সানস্ক্রিনগুলিতে UVA এবং UVB এর জন্য ফিল্টার রয়েছে এবং কিছু ফিল্টার এই উভয় তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে নিরপেক্ষ করে, বলছেন ডাঃ দিলীপ। তিনি আরও যোগ করে বলছেন যে,30 এর বেশি SPF সুপারিশ করা হয়।”
কেমিক্যাল সানস্ক্রিনের সাধারণ উপাদান
* অক্সিবেনজোন (UVA ফিল্টার)
* অ্যাভোবেনজোন (UVA ফিল্টার)
* অক্টিসলেট (UVB ফিল্টার)
* অক্টোক্রিলিন (UVB ফিল্টার)
* হোমোসলেট (UVB ফিল্টার)
* অক্টিনোক্সেট (UVB ফিল্টার)
“বাজারে সাধারণত পাওয়া যায় এমন সানস্ক্রিনগুলিতে এক বা একাধিক রাসায়নিক/জৈব উপাদান রয়েছে,” বললেন ডাঃ দিলীপ। এক্ষেত্রে ডাঃ সুদীপ এবং ডাঃ দিলীপ দুজনেই কেমিক্যাল সানস্ক্রিন ব্যবহারের কিছু সুবিধা ও অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছেন।
কেমিক্যাল সানস্ক্রিন ব্যবহারের সুবিধা
কেমিক্যাল সানস্ক্রিনগুলি প্রয়োগ করা খুবই সহজ, জল প্রতিরোধী এবং ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিনগুলির তুলনায় অনেক বেশি সময়ের জন্য সুরক্ষা দিতে পারে। এগুলি খুব সহজেই ত্বকের সমস্ত অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাদাটে ভাব রেখে যায় না।
কেমিক্যাল সানস্ক্রিন ব্যবহারের অসুবিধা
* যাঁদের ত্বক সংবেদনশীল এবং অ্যালার্জির প্রবণতা রয়েছে, তাঁদের জন্য রাসায়নিক সানস্ক্রিন সাধারণত সুপারিশ করা হয় না। কারণ, তাঁদের মধ্যে সানস্ক্রিন অ্যালার্জি বেশি দেখা যায়। এগুলি শিশুদের জন্যও সুপারিশ করা হয় না।
* কেমিক্যাল সানস্ক্রিন সংবেদনশীল ত্বকের লোকেদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে এবং মেলাসমা এবং রোসেসিয়াকে আরও খারাপ করতে পারে।
ডাঃ দিলীপের মতে, অনেক চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা গর্ভাবস্থায় এবং স্তন্যপান করানোর সময় কেমিক্যাল সানস্ক্রিন সুপারিশ করেন না। যদিও এই বিষয়ে কোনও স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। তাঁর কথায়, “রাসায়নিক সানস্ক্রিন ফটোঅ্যালার্জির কারণ হতে পারে, যা একজন ব্যক্তি সানস্ক্রিন প্রয়োগ করার পরে এবং রোদে বের হওয়ার পরে চুলকানি, জ্বলন, লাল ভাব বা ফুসকুড়ি হিসেবে প্রকাশ করতে পারে। তবে সকলের মধ্যে এমনটা হতে পারে তা নয়, যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের মধ্যে <1% অ্যালার্জি হয়।”
ফিজ়িক্যাল নাকি কেমিক্যাল, কোন সানস্ক্রিন ব্যবহার করবেন আপনি?
ডাঃ দিলীপের মতে, ফিজ়িক্যাল এবং কেমিক্যাল সানস্ক্রিনের মধ্যে মূল পার্থক্য হল, তারা কী ভাবে UV আলোতে প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেমিক্যাল ফিল্টারগুলি অতিবেগুনি আলোকে শোষণ করে এবং নিরপেক্ষ করে, সেই জায়গায় ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিনগুলি তাদের প্রতিফলিত করে।
ডাঃ সুদীপ বলছেন, ফিজ়িক্যাল এবং কেমিক্যাল উভয় ধরনের সানস্ক্রিনেরই নিজস্ব সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে। তবে, মানুষজন ফিজ়িক্যাল সানস্ক্রিন ব্যাপক ভাবে পছন্দ করেন। কারণ, এটি সমস্ত ত্বকের জন্য উপযুক্ত, ভাল সুরক্ষা দিতে এবং রক্ত প্রবাহে শোষিত হয় না।
আবার প্রসাধনিক দিক থেকে দেখতে গেলে কেমিক্যাল সানস্ক্রিনগুলি আরও ভাল। কারণ, এগুলি প্রয়োগ করাও সহজ এবং সূর্যের এক্সপোজ়ার থেকে দীর্ঘ সময়ের সুরক্ষা দিতে পারে। যদিও, সানস্ক্রিন বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানুষের পছন্দ ভিন্নতর হতে পারে। তবে, কারও ত্বকের যদি কোনও সমস্যা থাকে, তাহলে যে কোনও সানস্ক্রিন বেছে নেওয়ার আগে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া ভাল।