এই গরমে তাপমাত্রা প্রতিদিন যে হারে বেড়ে চলেছে, তাতে শান্তিতে ঘুমানোই একপ্রকার চিন্তার বিষয় হয়ে উঠছে। গ্রীষ্মকালে ঘুম পরিচালনা করার একাধিক উপায় রয়েছে ঠিকই। তবে, AC বা এয়ার কন্ডিশনারের থেকে ভাল উপায় আর কিছু নেই, যেখানে মানুষজন রাতে এসি চালিয়ে ঘর ঠান্ডা করে ঘুমাতে যান। বেশ কিছু গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ACতে ঘুমানো ঝুঁকিপূর্ণ নয়। যদিও তার স্বাস্থ্যগত প্রভাব অবশ্যই কিছু আছে। ঘুমের সময় একটানা এসি এক্সপোজারের ফলে শরীরের কী-কী ক্ষতি হতে পারে, তা তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঘুমের ধরন বদলাতে পারে, ব্যাহত হতে পারে ঘুম, শ্বাসকষ্ট হতে পারে, ত্বক শুষ্ক হতে পারে এবং শুকনো কাশি পর্যন্ত হতে পারে। দীর্ঘক্ষণ এসিতে ঘুমালে বাচ্চাদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্কদেরও শরীরের ক্ষতি হতে পারে।
AC চালিয়ে ঘুমানোর ফলে শরীরের উপরে প্রভাব
1. শুষ্ক ত্বক এবং চোখ
এয়ার কন্ডিশনার বাতাস থেকে আর্দ্রতার মাত্রা কমিয়ে দেয়। ঘরে এমনই একটা পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে আর্দ্রতার মাত্রা কম থাকে। ব্যাঙ্গালোরের জেনারেল ফিজ়িশিয়ান এবং ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডাঃ হালিমা ইয়েজদানি বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে ঘরে এসি চালিয়ে রাখলে তা আপনার ত্বককে শুষ্ক এবং শুকনো বোধ করাতে পারে সময়টাও একপ্রকার নির্দিষ্ট করেই তিনি যোগ করলেন, আট ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে এসির এক্সপোজ়ারের পরে এই সমস্যাগুলোই আরও বাড়তে পারে। শুধু তাই নয়। দীর্ঘক্ষণ AC চালিয়ে রাখা ঘরের শুষ্ক বাতাস আপনার চোখকে শুকনো এবং তীক্ষ্ণ বোধ করাতে পারে। তাতে অস্বস্তি বাড়তে পারে এবং চোখে চাপের সম্ভাবনাও বাড়িয়ে তোলে।
2. নিঃশ্বাসের সমস্যা
একটা এয়ার কন্ডিশনার যাতে দ্রুততার সঙ্গে ঘর ঠান্ডা করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য ঘরের সব জানলা, দরজা বন্ধ করে দিই। অপর্যাপ্ত বায়ুচলাচল এবং ক্রমাগত ঘরে এসি চলতে থাকার ফলে ঘরটিতে দম বন্ধ করার মতোই বাতাসে ভরে আসে। ডাঃ ইয়েজদানি বলছেন, “ঘরের মধ্যে সঠিক বায়ু চলাচল এবং তাজা বাতাসের সঞ্চালন না হলে ধূলিকণা এবং অ্যালার্জেনের মতো অভ্যন্তরীণ দূষক ঘরের মধ্যে আবদ্ধ স্থানগুলিতে জমা হতে পারে। ” আপনি যখন সারারাত এসি চালিয়ে একটি ঘরে ঘুমান, তখন স্থির বাতাস এই দূষকগুলিকে তৈরি করে। তার ফলে ঘরের ভিতরের বায়ুর গুণমান খারাপ হয়। শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি এবং হাঁপানির মতো লক্ষণগুলির কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। তার থেকেও বড় কথা হল, আর্দ্রতা সীমাবদ্ধ বাতাসে আটকে থাকার ফলে ঘরে ছত্রাকের বাড়বাড়ন্ত হয়, যা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং অপ্রীতিকর গন্ধ সৃষ্টি করতে পারে।
3. শুকনো কাশি
একটি এসি থেকে আগত শুষ্ক বাতাস শ্বাসযন্ত্রে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে ক্রমাগত শুষ্ক কাশি হতে পারে। ইয়েজদানি বলেছেন, “বাতাসে আর্দ্রতার অভাবে গলা শুকিয়ে যেতে পারে এবং শ্বাসনালীতেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।” ঘুমের সময় শুষ্ক বাতাসের দীর্ঘস্থায়ী এক্সপোজারের ফলেও গলা জ্বালা হতে পারে।
4. কানে সংক্রমণ বা ব্লক
ইয়েজদানি বলছেন, এসি ভেন্ট থেকে ঠান্ডা বাতাসের সরাসরি এক্সপোজার কানকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে অস্বস্তি বা এমনকি ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে। তিনি যোগ করেন, “তাপমাত্রার আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে ইউস্টাচিয়ান টিউবগুলি (যা গলার পিছনের কানকে সংযুক্ত করে) সংকুচিত বা অবরুদ্ধ হতে পারে। তার ফলে কেউ কানে চাপ অনুভব করতে পারেন।”
5. ক্লান্তি ভাব
ঠান্ডা এবং শুষ্ক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ঘুমালে তা যে কারও ঘুমের গুণমানকে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারে। তার ফলে মানুষজন ক্লান্ত বোধ করতে পারেন এবং অসুস্থও হতে পারেন। আর রাতের ঘুম যদি ভাল না হয়, তাহলে মানুষ ঘনঘন ক্লান্তি বোধ করলে পরের দিনের প্রোডাক্টিভিটি বা উৎপাদনশীলতা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হয়। শুধু তাই নয়। মেজাজ খিটখিটে হতে পারে, সামগ্রিক সুস্থতাও প্রভাবিত হতে পারে।
6. শরীরের মূল তাপমাত্রা ব্যাহত হয়
ইয়েজদানি বলেছেন, এসিতে ঘুমানো আপনার শরীরকে অতিরিক্ত ভাবে ঠান্ডা করতে পারে, শরীরের প্রাকৃতিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াকেও ব্যাহত করে। একটি বেডরুমের তাপমাত্রা আরামদায়ক হওয়ার পাশাপাশিই মানসম্পন্ন ঘুমের জন্য আদর্শ হওয়া অপরিহার্য। যখন সেই ঘর খুবই ঠান্ডা হয়ে যায়, তখন মানুষের শরীরের তাপমাত্রা সাধারণের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস হতে পারে। “অস্বস্তি, কাঁপুনি-সহ নানাবিধ স্বাস্থ্যগত জটিলতার কারণ হতে পারে রাতে এসি চালিয়ে ঘুমানো। শিশু, বয়স্ক লোকজন, যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাঁদের জন্যও রাতে এসি চালিয়ে ঘুমানো সমস্যার হয়ে যায়।”
নবজাতক শিশুদের উপর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রভাব
ত্রিভান্দ্রামের এসপি মেডিফোর্ট হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ বিদ্যা বিমল বলেছেন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের শরীরের তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য করা হলে এয়ার কন্ডিশনারগুলি নবজাতক শিশুদের জন্য নিরাপদ। তিনি যোগ করেন যে অভিভাবকদের উচিত তাদের নবজাতকদের ঘরে আনার অন্তত 20 মিনিট আগে এসি চালু করা এবং তাপমাত্রা 25-27 ডিগ্রি সেলসিয়াসে বজায় রাখা উচিত। “অভিভাবকদের নিশ্চিত করা উচিত যে শিশুরা সরাসরি ঠান্ডা বাতাসের সংস্পর্শে না আসে যাতে তাদের কাশি না হয়, যা নিউমোনিয়া হতে পারে,” তিনি যোগ করেন।
কিছু নবজাতক এবং শিশুরও ঠান্ডায় অ্যালার্জি হতে পারে; অতএব, তাদের অত্যন্ত ঠান্ডা তাপমাত্রায় প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয় নয়। তাছাড়া, ধুলোর মতো অন্যান্য অ্যালার্জি এড়াতে এয়ার কন্ডিশনারগুলি ঘন ঘন পরিষ্কার করা উচিত।
সদ্যোজাতদের উপর এয়ার কন্ডিশনারের প্রভাব
এয়ার কন্ডিশনারগুলি সদ্যোজাতদের জন্য নিরাপদ হতে পারে। যদি ACগুলির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত রাখা যায় এবং বাচ্চাদের শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য করা যায়, জানালেন ত্রিভান্দ্রামের এসপি মেডিফোর্ট হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ বিদ্যা বিমল। তিনি যোগ কর বললেন যে, অভিভাবকদের উচিত তাঁদের বাচ্চাদের ঘরে আনার অন্তত 20 মিনিট আগে এসি চালু করা এবং তাপমাত্রা 25-27 ডিগ্রি সেলসিয়াসে বজায় রাখা উচিত। ডাঃ বিদ্যার বক্তব্য, “অভিভাবকদের নিশ্চিত করা উচিত, যেন শিশুরা সরাসরি ঠান্ডা বাতাসের সংস্পর্শে না আসে এবং তাদের কাশি না হয় ও নিউমোনিয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা না দেয়।”
ঠান্ডায় কিছু সদ্যোজাত শিশুর অ্যালার্জি পর্যন্ত হতে পারে। তাই, তাদের ঘরের এসির তাপমাত্রা অত্যন্ত ঠান্ডা করা উচিত নয়। তাছাড়া, ধুলোর মতো অন্যান্য অ্যালার্জি এড়াতে এয়ার কন্ডিশনারগুলি ঘন ঘন পরিষ্কার করা উচিত।
কী ভাবে AC চালিয়েও রাতে ঘুমিয়ে ভাল থাকা যায়?
গরম যে রকম হারে বাড়ছে, তাতে এসি চালানো ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই। তাই, রাতে ঘুমাতে এসি যখন চালাতেই হবে, তখন কী ভাবে শরীরটাও ভাল রাখা যায় তার কৌশলও জেনে নিতে হবে।
এসির তাপমাত্রা
ঘুমানোর সময় এসির তাপমাত্রা 20-25 ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই রাখা ভাল, জানাচ্ছেন ইয়েজদানি সুপারিশ। তবে, এসির তাপমাত্রা সেট করার পিছনে মানুষের নিজস্ব পছন্দটাও কাজ করে। তাই, স্বতন্ত্র পছন্দগুলি পরিবর্তিত হতে পারে এবং বাইরের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার মাত্রার মতো বাহ্যিক কারণগুলির উপর ভিত্তি করে সমন্বয়েরও প্রয়োজন হতে পারে। অত্যন্ত গরমে মানুষজন কম তাপমাত্রায় এসি সেট করতে প্রলুব্ধ হতে পারেন। তবে তা অতিরিক্ত শীতলতা এবং সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
এসিতে কতক্ষণ থাকবেন
ইয়েজদানি বলছেন, যদিও সেন্ট্রালাইজড এসি রয়েছে যে সব জায়গায়, সেখানে ক্রমাগত এক্সপোজার এড়ানোর কোনও উপায় নেই। কিন্তু সেই এক্সপোজার আপনার স্বাভাবিক ঘুমের ধরনকে ব্যাহত করতে পারে। তাঁর কথায়, “ঘুমের সময় এসির ব্যবহার 1-2 ঘণ্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এসি চালালেও তা খুব অল্প সময়ের জন্যই চালিয়ে ঘর ঠান্ডা করে রাখা উচিত। তাছাড়া আরামদায়ক তাপমাত্রা বজায় রাখতে প্রোগ্রামেবল থার্মোস্ট্যাটগুলি ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়।”