আচ্ছা, আদিম মানবের মতো যদি জামা-প্যান্ট খুলে এক্কেবারে উল্লঙ্গ হয়ে ঘুমানো যেত, কেমন হত তাহলে? এই হাঁসফাঁস করে ওঠা গরমে আর কিছু হোক বা না হোক অন্তত ঘুমটা ভাল হত! কী তাই তো নাকি! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগ্ন হয়ে ঘুমানো একটি অপ্রচলিত অভ্যাস হলেও তা আপনার ঘুমের মান উন্নত করতে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে, দম্পতিদের অন্তরঙ্গ স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে, এমনকি ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। শুধু তাই নয়। গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে যে, শীতকালে নগ্ন হয়ে ঘুমালে দ্রুত ঘুম আসে এবং স্বাস্থ্যকর বিপাক বজায় থাকে। যাঁরা আবার একটু উষ্ণতা পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য গরম বিছানারও বিকল্প রয়েছে যেখানে জামা-কাপড় ছাড়াই ঘুমানো সম্ভব হয়, দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
2022 সালে ব্রিটেনে পরিচালিত উল্লঙ্গ হয়ে ঘুমানো সংক্রান্ত একটি গবেষণায় এর একাধিক সুবিধার কথা উঠে এসেছে। এই সমীক্ষাটি ব্রিটেনের 15,000 প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উত্তরদাতাদের 20 শতাংশ নগ্ন হয়ে ঘুমাতে পছন্দ করেন। মজাদার বিষয়টি হল, শুধু অল্পবয়সীরা নয় নগ্ন হয়ে ঘুমাতে পছন্দ করেন প্রাপ্তবয়স্করাও। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের 26 শতাংশের বয়স 65 বছরের বেশি এবং 17 শতাংশের বয়স 18 থেকে 24 বছরের মধ্যে।
নগ্ন হয়ে ঘুমালে আমাদের কী উপকার হয়?
ব্যাঙ্গালোরের অ্যাস্টার সিএমআই-এর ইন্টারভেনশনাল পালমোনোলজির প্রধান পরামর্শদাতা ডাঃ সুনীল কুমার কে বলছেন, নগ্ন হয়ে ঘুমানোর একাধিক সুবিধা আছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং গোপনাঙ্গে সংক্রমণ প্রতিরোধ। তবে নগ্ন হয়ে ঘুমানোর পরামর্শ এখনই তিনি কাউকে দিতে চাইছেন না, যেহেতু এর বৈজ্ঞানিক বৈধতা এখনও অপর্যাপ্ত।
হ্যাপিয়েস্ট হেলথের তরফে ইমেল মারফত যোগাযোগ করা হয়েছিল ব্রিটেনের চার্টার্ড ফিজ়িওথেরাপিস্ট এবং ঘুম বিশেষজ্ঞ স্যামি মার্গোর সঙ্গে। সেখানে তিনি নগ্ন হয়ে ঘুমানোর কিছু উল্লেখযোগ্য দিকের কথা বলেছেন, যা ওই গবেষণায় উত্তরদাতাদের সঙ্গে মিলে গিয়েছে।
নগ্ন হয়ে ঘুমানোর কিছু শারীরিক ও মানসিক সুবিধা সম্পর্কে জেনে নিন:
1. শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে
নগ্ন হয়ে ঘুমানোর একটি অন্যতম সুবিধার দিক হল, এর মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পোশাকের সীমাবদ্ধতা না থাকার ফলে আপনার শরীর রাতের তাপমাত্রার সঙ্গে আরও ভাল ভাবে মানিয়ে নিতে পারে। সেই সঙ্গেই উল্লঙ্গ হয়ে ঘুমানো নিরবচ্ছিন্ন এবং আরামদায়ক ঘুমের পথ তৈরি করে। পরোক্ষ ভাবে,মানসিক চাপ এবং উত্তেজনা কমিয়ে আনতে পারে, যার ফলে মানুষ অনেকটাই হাল্কা হয়ে ঘুমাতে পারেন।
2. জলদি ঘুম আসে
ঘুমের সময় আপনার শরীরের তাপমাত্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিষয়টি একজন ব্যক্তির সার্কাডিয়ান ছন্দের সঙ্গে জটিল ভাবে যুক্ত, যেখানে আপনার ঘুম ও জেগে থাকার চক্র নিয়ন্ত্রিত হয় শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ির দ্বারা। নগ্ন হয়ে ঘুমালে আপনার শরীর ঠান্ডা থাকে এবং এই পরিস্থিতি শরীরকে সংকেত দিতে পারে যে এখনই ঘুমানোর প্রকৃত সময়। ফলে, তাড়াতাড়ি ঘুমও চলে আসে।
3. ঘুমের মান বাড়ায়
গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, নগ্ন অবস্থায় ঘুমানো আপনার ঘুমের গুণমানকে উন্নত করতে পারে। ঘুমের সময় যখন আপনার শরীর স্বাভাবিকভাবে শীতল হয়, তখন ঘুম আরও গভীর হয়। তারপরে আপনার যখন ঘুম ভাঙবে এবং দিনটা শুরু করবেন, তখন নিজেকে আরও সতেজ এবং উজ্জীবিত বোধ করবেন।
4. ত্বকের স্বাস্থ্য ভাল রাখে
পোশাক ঘাম এবং ব্যাকটেরিয়া আটকাতে পারে, যা ত্বকের জ্বালা এবং সংক্রমণের দিকে পরিচালিত করে। জামা-কাপড় না পরে ঘুমালে আপনার ত্বককে শ্বাস নিতে পারে, বায়ু সঞ্চালন আরও ভাল হয়। স্বাভাবিকভাবেই ত্বকের সংক্রমণ, ব্রণ এবং অন্যান্য ত্বক সংক্রান্ত সমস্যার ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া, এটি আপনার যৌনাঙ্গের স্বাস্থ্যও উন্নত করে।
5. ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়
দম্পতিদের জন্য জামা-কাপড় ছাড়াই একটি বিছানায় শোওয়া ঘনিষ্ঠতার অনুভূতিকে লালন করতে পারে। ত্বক থেকে ত্বকের যোগাযোগ অক্সিটোসিন নিঃসরণ করে, যাকে ‘প্রেমের হরমোন’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এর দ্বারা শারীরিক ঘনিষ্ঠতা আরও জোরদার হয় এবং মানসিক স্নেহের অনুভূতি বাড়ায়।
6. ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
বিশ্বাস করুন বা না করুন, নগ্ন হয়ে ঘুমানো ওজন কমানোর প্রচেষ্টায় সাহায্য করতে পারে। ঘুমের সময় যখন আপনার শরীর ঠান্ডা থাকে, তখন এটি বাদামী চর্বিকে সক্রিয় করে। এটি এমনই এক ধরনের চর্বি, যা তাপ উৎপন্ন করতে ক্যালোরি পোড়ায়। উল্লঙ্গ হয়ে ঘুমানো বাদামী চর্বি সক্রিয়করণকে উৎসাহিত করে, সেই সঙ্গেই আবার বিপাকীয় হার বাড়াতে পারে এবং দ্রুত ক্যালোরি বার্নও করতেও অবদান রাখতে পারে।
7. আত্মবিশ্বাস বাড়ায়
আপনি যখন ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন, ত্বক নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারবেন, তখন আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়তে বাধ্য। ভাল ঘুম, আপনার শারীরিক গঠন ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আপনার উপরে সামগ্রিক ভাবে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে।
নগ্ন হয়ে ঘুমানো নতুন কোনও বিষয় নয়: গবেষণা
আদিম মানবের বিবর্তনের ইতিহাসে রয়েছে কনকনে ঠান্ডা তাপমাত্রায় কাপড় ছাড়া ঘুমানোর শিকড়। উদাহরণস্বরূপ, বায়োসায়েন্সে (2023) প্রকাশিত ‘লিভিং নেকেড ইন দ্য কোল্ড’-এর গবেষণায় শত শত বছর ধরে নগ্ন হয়ে ঘুমানো কীভাবে সম্ভব ছিল তা তিনটি সংস্কৃতিতে আলোচনা করা হয়েছে – দক্ষিণ আফ্রিকার বুশম্যান, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী মানুষ এবং তিয়েরা দেল ফুয়েগোর ইয়ামানা এবং আলাকালুফ-এর।
এই সম্প্রদায়গুলি সারা রাত উষ্ণ থাকার জন্য আগুন জ্বালিয়ে রাখত। তবে তাঁদের পরনে পোশাক থাকত না। শীতলতম আবহাওয়ায় তাঁরা বড় ফায়ারপ্লেস তৈরি করে, সেই ফায়ারপ্লেসের কাছে ঘুমাত। তবে ঝোড়ো হাওয়ায় প্রায়শই আগুন নিভে যেত। আগুন যাতে না নেভে, তার জন্য তাঁরা জ্বালানির ব্যবস্থা করত।
মোদ্দাকথা
* নগ্ন হয়ে ঘুমানো সহজ এবং অর্জনযোগ্য বলে না-ও মনে হতে পারে। তবে মানব ইতিহাসে এমন কিছু চিহ্ন রয়েছে, যা এটিকে কীভাবে সম্ভব করা যেতে পারে তার উপায় বলে।
* নগ্ন হয়ে ঘুমানোর কিছু আশ্চর্যজনক সুবিধার কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন, ঘুমের মান উন্নত হয় , তাপমাত্রা ও ওজন নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
* ব্রিটেনের একটি সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়েছে যে, সে দেশের এক পঞ্চমাংশ নগ্ন অবস্থায় ঘুমাতে পছন্দ করেন। সেখানে এ-ও উল্লেখ করা হয়েছে যে, নগ্ন হয়ে ঘুমানোর বেশ কিছু সুবিধার কারণে মূলত বয়স্করা এই ভাবে ঘুমাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।