জীবনযাপন ছিল বড়ই অস্বাস্থ্যকর। হায়দরাবাদের সেই তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীর বয়স মাত্র 30 বছর। নাইট শিফ্টে কাজ করতেন। তাই, ঘুম এবং সারাদিনের রুটিনটাই তাঁর ঘেঁটে ঘ হয়ে গিয়েছিল! মদ্যপান লেগেই ছিল, সেই সঙ্গেই ছিল লাগাতার ধূমপান। রাতে যেহেতু কাজ করতে হত, তাই ঘুমাতে হত দিনের বেলা। অর্থাৎ তাঁর রোজনামচা যেন উল্টো দিকে ঘুরছিল। কাজের জায়গায় পারফরম্যান্স ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। এমনই একটা পরিস্থিতিতে তিনি মাইক্রোস্লিপ অনুভব করতে থাকেন। মাইক্রোস্লিপ… সে আবার কী? এ হল এমনই এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি যখন আপনি কাজের সময় ঘুমিয়ে পড়েন। ওই আইটি কর্মী সে দিন কাজ থেকে ফেরার সময় মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। প্রচণ্ড নিদ্রাহীনতায় শেষে তাঁকে একটি পথ দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়।
30 বছর বয়সী এই আইটি কর্মীর পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে হায়দরাবাদের যশোদা হাসপাতালের ইন্টারভেনশনাল পালমোনোলজি অ্যান্ড স্লিপ মেডিসিনের কনসালট্যান্ট ডাঃ বিশ্বেশ্বরণ বালাসুব্রহ্মণ্যম বলেন, “ওই ব্যক্তি আমাদের কাছে আসেন এবং আমরা জানতে পারি যে, তাঁর ঘুমের প্যাটার্ন অনিয়মিত ছিল। তিনি রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় মগ্ন থাকতেন, যা তাঁকে দীর্ঘ সময় ধরে জাগিয়ে রাখত। আমি তাঁকে প্রথমেই সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার কমাতে বলি এবং তারপরে রাতে ঘুমানোর সময় গ্যাজেটগুলিকে দূরে সরিয়ে রাখার পরামর্শ দিই।”
ডাঃ বালাসুব্রহ্মণ্যম জানালেন, ওই ব্যক্তি আকারে একটু মোটাই ছিলেন এবং তাঁর যথেষ্ট পরিমাণে নাক ডাকার সমস্যা ছিল। তিনি আরও বললেন, “তাঁর উপরে একটি স্লিপ স্টাডি করার সিদ্ধান্ত নিই আমরা। তাতে তাঁর অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (OSA) ধরা পড়ে। পজিটিভ এয়ারওয়ে ডিভাইস ব্যবহার করে তাঁর স্লিপ অ্যাপনিয়া চিকিৎসা করা হয় এবং স্থূলতা নিয়ন্ত্রণের জন্য তাঁকে ডায়েটও দেওয়া হয়েছিল।” চিকিৎসার পর থেকে কর্মক্ষেত্রে ভাল পারফর্ম করা শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি আগের মতো সে ভাবে আর অলসও বোধ করতেন না ওই আইটি কর্মী।
ডাঃ বালাসুব্রহ্মণ্যমের কথায়, “যদিও এক্ষেত্রে মাইক্রোস্লিপের তুলনায় স্লিপ অ্যাপনিয়াই মুখ্য ছিল। কিন্তু ওই ব্যক্তি যেহেতু একটা লম্বা সময় ধরে ঠিক ভাবে ঘুমোতে পারছিলেন না। তাই, তিনি গাড়ি চালানোর সময় কখনও-কখনও মাইক্রোস্লিপেরও শিকার হচ্ছিলেন।”
মাইক্রোস্লিপ কতক্ষণের জন্য স্থায়ী হতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাইক্রোস্লিপ হল এমনই এক অবস্থা যখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষ ঘুমে ঢুলে পড়েন এবং এই পর্ব মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যই স্থায়ী হয়। ডাঃ বালাসুব্রহ্মণ্যম বলেন, “এই পর্ব চলতে থাকলে মানুষজন কিছু সময়ের জন্য সচেতনতা হারিয়ে ফেলেন।”
মাইক্রোস্লিপ বিভিন্ন কারণে দেখা দিতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ডাঃ বালাসুব্রহ্মণ্যম বলছেন, “মাইক্রোস্লিপ মানুষের অ্যাকাডেমিক এবং প্রফেশনাল উভয় পারফরম্যান্সকেই প্রভাবিত করতে পারে। পড়ুয়ারা বা কর্মীরা যে সব কাজে নিয়োজিত থাকেন, তার জন্য তাদের তীব্র মনোসংযোগের প্রয়োজন হয়। কিন্তু মাইক্রোস্লিপের কারণে তা বেশ কিছুটা ব্যাহত হয় এবং আখেরে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে আপস করতে হয়। কাজে ভুল হতে থাকে, বিভিন্ন জরুরি তথ্য মানুষ ভুলতে থাকেন এবং একজনের সামগ্রিক দক্ষতা কমতে থাকে।”
এককথায় মাইক্রোস্লিপ খুবই বিপজ্জনক। কারণ, এটি এমনই কিছু পরিস্থিতিতে আপনার কাছে আসতে পারে, যখন আপনি গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ কোনও কাজ করছেন। হতে পারে আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন, আবার এমনও হতে পারে, আপনি হয়তো তখন ভারী কোনও যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছেন।
কোনও ব্যক্তির মাইক্রোস্লিপের কারণ কী?
2022 সালে জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ হল মানুষের অনিয়মিত ঘুম। অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বা OSA আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও গাড়ি চালানোর সময় ঘুমিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
“মাইক্রোস্লিপের অন্যতম সাধারণ কারণ হল ঠিক করে না ঘুমানো বা ঘুমের বঞ্চনা। এই অবস্থাটি মোটেও সাধারণ নয়, তবে তা মানুষের দুর্বলতার উপর নির্ভর করে। সাধারণত যখন কোনও ব্যক্তি পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান না বা ঘুমের সুযোগ পান না, তখন তাঁদের শরীর স্বল্প সময়ের ঘুমের বন্দোবস্ত করে অপর্যাপ্ত ঘুমের ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করে”, বলছেন ব্যাঙ্গালোরের অ্যাস্টার সিএমআইয়ের ইন্টারভেনশনাল পালমোনোলজির প্রধান পরামর্শক ড. সুনীল কুমার কে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিদ্রা বা স্লিপ অ্যাপনিয়ার মতো ঘুমের ব্যাধিগুলিও মাইক্রোস্লিপের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। “অনিয়মিত ঘুমের ধরন এবং সার্কাডিয়ান রিদিমে (মানবদেহের নিজস্ব ঘড়ি, যা মেনে খাওয়া, ঘুমানো সবকিছু হয়) ব্যাঘাত, যেমন নাইট শিফ্টের কারণে রাতে কাজ এবং অন্য সময় ঘুমানো মাইক্রোস্লিপের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তার পাশাপাশিই আবার স্ট্রেস এবং ক্লান্তিও একজন ব্যক্তির মধ্যে মাইক্রোস্লিপের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে,” বলছেন ডাঃ বালাসুব্রহ্মণ্যম।
মাইক্রোস্লিপের সঙ্গে মোকাবিলা করার 6 উপায়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাইক্রোস্লিপের ঝুঁকি কমানোর জন্য সর্বাগ্রে ঘুমকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তার জন্য একটা স্বাস্থ্যকর ঘুমের পরিবেশ বজায় রাখাটাও জরুরি। সেই সঙ্গেই আবার স্ট্রেস ম্যানেজ করার ব্যাপারেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন তাঁরা।
1. ভাল মানের ঘুম নিশ্চিত করুন
ডাক্তাররা বলছেন, মাইক্রোস্লিপ প্রতিরোধ করার জন্য একজন মানুষকে নির্বিঘ্নে অন্তত ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। তবে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের জন্য ভাল স্বাস্থ্যবিধিও অনুশীলন করাটা জরুরি। একমাত্র তাহলেই যথাসময়ে আপনার ঘুম আসবে এবং আপনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ঘুমোতেও পারবেন।
2. শারীরিক কার্যকলাপে নিযুক্ত থাকতে হবে
হাঁটাচলা, জগিং, স্ট্রেচিংয়ের মতো ব্যায়াম হরমোনের উৎপাদন হ্রাস করতে পারে এবং বিপাক উন্নত করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। সুনীল কুমার বলছেন, “ব্যায়াম করলে তা ওজন কমাতেও সাহায্য করবে, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যারও সমাধানে সক্ষম হবে।”
3. শোওয়ার সময় কফি/অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন
ঘুমানোর আগে কফি খেলে চলবে না, তাতে অ্যাসিড রিফ্লাক্স হতে পারে এবং ঘুম ব্যাহতও হতে পারে। ডাঃ বালাসুব্রহ্মণ্যম বললেন, “কফি বা চায়ের মতো উদ্দীপকগুলিতে ক্যাফিন থাকে, যা মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদনকে দমন করতে পারে। ঘুম আসা এবং পরবর্তীতে তা বজায় রাখার জন্য এই হরমোনের উৎপাদন খুবই প্রয়োজনীয়। তাই এটা এড়িয়ে চলা উচিত।
4. ঘুমানোর আগে গ্যাজেটস দূরে সরিয়ে রাখতে হবে
বিভিন্ন গ্যাজেট থেকে নির্গত নীল আলো আমাদের স্লিপ সাইকেল বা ঘুমের চক্রের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ফলে, একজন মানুষের ঘুমাতে আরও সময় লাগে। সেই কারণেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, ঘুমানোর অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে গ্যাজেটগুলিকে দূরে সরিয়ে রাখুন।
5. স্ট্রেস কমাতে হবে
স্ট্রেস এমনই এক জটিল বিষয়, যা একজন ব্যক্তির কর্টিসল (স্টেরয়েড হরমোন) মাত্রা বাড়ায় এবং ঘুমকে প্রভাবিত করে। যোগব্যায়ামের মতো বিভিন্ন রিল্যাক্সেশন কৌশল অবলম্বন করতে হবে, যা প্রফেশনালদের মধ্যে স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করবে।
6. বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে
মাইক্রোস্লিপের অন্যতম কারণই হল ঘুমের অভাব। ডাঃ কুমার বলছেন, “ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা এবং অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার মতো ঘুম সংক্রান্ত রোগগুলি মানুষের মধ্যে মাইক্রোস্লিপ ডেকে আনতে পারে। তাই, দীর্ঘ সময় ধরে যদি আপনার ঘুমের সমস্যা চলতেই থাকে, তাহলে বিশেষজ্ঞ বা একজন হেল্থ প্রফেশনালের সাহায্য নিতে হবে।”
মোদ্দাকথা
* মাইক্রোস্লিপ হল এমনই একটি অবস্থা, যখন কোনও ব্যক্তি খুব অল্প সময়ের জন্য ঢুলে যান এবং তার মধ্যে ঘুম আসার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
* এই অবস্থা আসলে খুবই বিপজ্জনক, বিশেষ করে যখন কোনও মানুষ গাড়ি চালাচ্ছেন বা অন্য কোনও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে রয়েছেন।
* ঘুমের ভাল মান নিশ্চিত করতে ঘুমানোর আগে ক্যাফিন/অ্যালকোহল ইত্যাদি এড়িয়ে যেতে হবে।