বার্ধক্য অনিবার্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বার্ধক্য শরীরের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় ক্ষেত্রেই হয়। অভ্যন্তরীণ পেশী শক্তি, আঁটসাঁট গঠন, শরীরের অভ্যন্তরে ভালভাবে কাজ করে এমন অঙ্গ এবং বাইরের দিকে উজ্জ্বল ত্বক তারুণ্যের ইঙ্গিত দেয়। বয়সের সাথে সাথে এইসব উপাদানগুলির মধ্যে এক ধরনের ঘাটতি লক্ষ্য করার যায়।
”শরীরের বৃহত্তম অঙ্গ, ত্বক, বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে সুস্পষ্ট করে তোলে। “বার্ধক্য ত্বকের কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি অভ্যন্তরীণ কারণ (যেমন, জিন) বা বহিরাগত কারণগুলির (যেমন, UV রশ্মি, ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, বায়ু দূষণ বা অপুষ্টি) জন্য হতে পারে” নিউ দিল্লির নিউট্রিশন ডিফাইন্ড -এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ক্লিনিকাল নিউট্রিশনিস্ট, রিধিমা বাত্রা ব্যাখ্যা করেন৷
“প্রায়শই, জিনগত প্রবণতার চেয়ে বহিরাগত কারণগুলি ত্বকের বার্ধক্যকে বেশি করে প্রভাবিত করে,” বেঙ্গালুরুর নিউট্রিশনিস্ট, ইনস্টাগ্রামার এবং যোগা টিচার, শালিনী অভিলাষ, উল্লেখ করেন৷
কোলাজেন হ্রাস: ত্বকের বার্ধক্যের মূল কারণ
“কোলাজেন হল অ্যামিনো অ্যাসিড যা বার্ধক্যকে নির্ধারণ করে। প্রোটিন-ভিত্তিক এই টিস্যুটি জয়েন্ট, মাসল এবং টিস্যুকে সংযুক্ত করে। এটি ত্বকের আণবিক গঠনকে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করে, “শালিনী বলেন
২৫ বছর বয়স পর্যন্ত এটি আমাদের সমস্ত শরীরে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, শালিনী ব্যাখ্যা করেন। “২৫ বছর বয়সের পর, কোলাজেন উৎপাদন প্রতি বছর ১০-১৫ শতাংশ করে কমতে থাকে।”
রিধিমা ব্যাখ্যা করেন যে বয়সের সাথে সাথে ত্বকে দেখা যায় এমন পরিবর্তনগুলির প্রধান কারণ হল কোলাজেন হ্রাস। কোলাজেন হ্রাস পাওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি সম্ভাবনা হল ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, প্রসেসড ফুড, অতিমাত্রায় চিনি খাওয়া এবং অনিয়মিতরূপে হওয়া ঘুম।
ঘুমের ঘাটতি বা খারাপ ঘুমের অভ্যাসও তাড়াতাড়ি বার্ধক্যের সূচনা করতে পারে, শালিনী সতর্ক করেন।
বার্ধক্য-র প্রাথমিক লক্ষণ
রিধিমা ব্যাখ্যা করেন যে ত্বকের বার্ধক্যের প্রাথমিক লক্ষণগুলি যেগুলির দ্বারা নির্দেশিত হয়, সেগুলি হল:
- হাইপারপিগমেন্টেশন
- ঝুলে পড়া ত্বক বা ত্বকের নমনীয়তা হ্রাস
- চুল পেকে যাওয়া বা চুল পড়া
উচ্চ মাত্রায় কোলাজেন উৎপাদন মানে বিলম্বিত বার্ধক্য
কোলাজেনের উৎপাদন বৃদ্ধি বার্ধক্যকে বিলম্বিত করতে পারে। গবেষণাগুলি সুপারিশ করে যে এটি যুক্তিসঙ্গত ডায়েট এবং সুষম পুষ্টির মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে। শালিনী স্পষ্ট করে বলেন যে মাংসই একমাত্র খাবার যেখানে কোলাজেন আছে, কিন্তু বয়স বাড়া রোধ করার জন্য মাংসের উপর নির্ভর হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। শালিনী বলেন, প্রচুর ফাইবার সহ প্লান্ট-বেসড ডায়েট খাওয়া কোলাজেনের উৎপাদনকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
তিনি বলেন, “১০০ গ্রাম মাংসে প্রায় ০.৩% কোলাজেন থাকে।”
যে খাবারগুলি প্রদাহরোধী, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি, জিঙ্ক, কপার, সিলিকন, গ্লাইসিন, লাইসিন সমৃদ্ধ সেই খাবারগুলি কোলাজেন তৈরি করতে সাহায্য করে, রিধিমা বলেন।
বার্ধক্য রোধী খাবার: কোথায় রয়েছে সেই অমৃত?
“অধিকাংশ উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবারে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে,” শালিনী বলেন। “কিন্তু, কিছু কিছু খাবার কয়েক মিলিগ্রাম অ্যান্টিওক্সিডেন্ট এবং/অথবা ফাইবার সমৃদ্ধ।” অল্প বয়স থেকে এক স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করাই হল বার্ধক্যকে বিলম্বিত করার মূল চাবিকাঠি, শালিনী জোর দিয়ে বলেন।
বেঙ্গালুরুর ৪২ বছর বয়সী আইটি প্রফেশনাল, আশা আর, হ্যাপিয়েস্ট হেলথকে বলেন, তিনি আমলকির রস স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারি তা জেনে টানা এক বছর ধরে আমলকির রস খেতে শুরু করেছিলেন। “আমি এই রস সকালে খালি পেটে পান করি। আমি অনুভব করতে পারি, আমার দৈহিক শক্তির মাত্রা আরও উন্নত হয়েছে। আমার ত্বকও এক বছর আগের তুলনায় আরও স্বাস্থ্যকর এবং আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।”
বার্ধক্য রোধী খাবারের তালিকায় অঢেল খাবার রয়েছে, সেগুলি হল:
· অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী
গবেষণায় দেখা গেছে অ্যালোভেরার শাঁসে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। শালিনী উল্লেখ করেন যে অ্যালোভেরার রস সকালে খাওয়া হলে সেটি শরীরে সবচেয়ে ভালভাবে কাজ করে। তিনি পরামর্শ দেন যে সজনে পাতা, গমের ঘাস এবং বারমুডা ঘাস থেকে তৈরি অন্যান্য উদ্ভিদ-ভিত্তিক রসগুলিও স্বাস্থ্যকর পুষ্টি লাভ করার জন্য খাওয়া উচিত।
· ক্রুসিফেরাস বা কপির মতো শাক-সবজি
রিধিমা বলেন, ব্রোকলি, ব্রাসেল স্প্রাউট, বাঁধাকপি এবং অন্যান্য শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্রুসিফেরাস সবজিতে পাওয়া জৈব রাসায়নিক, সালফোরেন্স এবং আইসোথিওসায়ানেট, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রেসপন্সকে সক্রিয় করে।
· মাশরুম
মাশরুম অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। তবে শালিনী আরও বলেন যে অ্যালার্জির ফলে হওয়া প্রতিক্রিয়া বা অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন এড়াতে মাশরুমকে অবশ্যই রান্না করে খেতে হবে। “সপ্তাহে দু’বার বা তিনবারের বেশি খাবেন না।”
· গুজবেরি
ইন্ডিয়ান গুজবেরি, যাকে আমলাও বলা হয়, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ একটি ফল। শালিনী আরও বলেন যে গুজবেরির এক অনন্য বার্ধক্যরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা কোলাজেন উৎপাদনকে বাড়িয়ে তোলে। তিনি আরও বলেন, এটি ভোরের দিকে খাওয়া উচিত।
· ডার্ক চকলেট
কোকোর বীজ থেকে তৈরি ডার্ক চকলেট বার্ধক্যরোধী খাবারে নতুন পরিসর তৈরি করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে কোকো বিনস বা কোকোর বীজগুলি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (পলিফেনল এবং ফ্ল্যাভোনয়েড) সমৃদ্ধ। তবে সেটির প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতিটি এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যগুলির বেশিরভাগকেই সরিয়ে দেয়। শালিনী সতর্ক করেন, “ডার্ক চকোলেট একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তবে তাতে যে চর্বি এবং চিনি আছে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে’’।
তিনি পরামর্শ দেন, “একজন নন-ডায়াবেটিক ব্যক্তি দিনে ছয় থেকে আট গ্রাম ডার্ক চকলেট খেতে পারেন।”
চেন্নাইয়ের অথুল্যা সিনিয়র কেয়ারের একজন ক্লিনিকাল নিউট্রিশনিস্ট ডাঃ সুগন্য এন উল্লেখ করেন যে সমস্ত অ্যান্টি-এজিং খাবার প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের শরীরের জন্য উপযুক্ত নয়। উদাহরণস্বরূপ, হাইপোথাইরয়েডিজম আছে এমন লোকেদের ক্রুসিফেরাস সবজি হজম করতে বেশি সময় লাগে। সুতরাং, কাউকে অবশ্যই এটি রান্না করে এবং সীমিত পরিমাণে খেতে হবে, ডাঃ সুগন্য বলেন। তিনি আরো বলেন, প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা দূরবর্তী স্থান থেকে উৎসারিত খাবার খাওয়ার চেয়ে স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ কৃষিজাত পণ্য গ্রহণ করা ভালো।
ভারসাম্য বজায় রাখা
পুষ্টিবিদরা সতর্ক করেন যে শুধুমাত্র বার্ধক্য রোধী খাবার খাওয়া শরীরের ভারসাম্যকে ব্যাহত করতে পারে। ফল, শাকসবজি এবং প্রোটিন সহ ডায়েটের সাথে চার থেকে পাঁচ বার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে, রিধিমা জানান।
শালিনী আরও বলেন যে একবারে প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাবার খাওয়া চ্যালেঞ্জিং হয়। দিনে তিন থেকে ছয় বার ছোট ছোট ভাগে খাবার খাওয়া এই বিষয়টিকে সাহায্য করে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, “রান্না করা প্রতি ১০০ গ্রাম শাক-সবজিতে সমৃদ্ধ ফাইবার বার্ধক্যকে বিলম্বিত করতে সহায়তা করবে।”
শালিনী বলেন, একটি অ্যান্টি-এজিং ড্রাগ যা ইচ্ছা করলেই পাওয়া যায় কিন্তু তার ব্যবহার খুব বেশি করা হয় না তা হল ঘুম।
সারসংক্ষেপ
- কোলাজেন উৎপাদন বাড়ায় এমন খাবার বার্ধক্যকে বিলম্বিত করতে পারে।
- ক্রুসিফেরাস সবজি, যেমন মাশরুম, ডার্ক চকলেট এবং গুজবেরি কোলাজেন তৈরি করতে পারে।
- অল্প বয়স থেকে এক স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করাই হল বার্ধক্যকে বিলম্বিত করার মূল চাবিকাঠি।
- শুধুমাত্র খাবার এবং ঘুম না হওয়াও ত্বকের বয়স বাড়াতে পারে।