বয়স্ক মানুষদের মধ্যে পড়ে যাওয়ার প্রবণতা ভারসাম্যহীনতার কারণে ঘটে থাকে । সুস্থ ভেস্টিবুলার ক্রিয়া থেকে মুক্ত হওয়ার সমাধান ।
ডা. প্রভা অধিকারী, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বয়স্ক স্বাস্থ্য চিকিৎসা বিভাগ, ইয়েনেপয়া মেডিকেল কলেজ, ম্যাঙ্গালুরু ‘হ্যাপিয়েস্ট হেল্থ’-কে জানিয়েছেন, মাঝবয়সী এবং বৃদ্ধদের মধ্যে, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে ভেস্টিবুলারের সমস্যা খুবই দেখা যায় ।
২০১৯ সালের এক গবেষণা পত্র ‘দ্য এজিং ভেস্টিবুলার সিস্টেম: ডিজিনেস এন্ড ইম্ব্যালান্স ইন দ্য এল্ডারলি’ জানিয়েছে যে ৬০ বছরের বেশীদের মধ্যে শতকরা ২০ জন, ৭০ বছরের বেশীদের মধ্যে শতকরা ৩০ জন এবং ৮০ বছরের বেশীদের মধ্যে শতকরা ৫০ জন মাথা ঘোরার সমস্যায় ভোগেন বলে তাঁদের দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত ঘটে ।
মাথা ঘোরা থেকে পড়ে যাওয়া বা চলাফেরার অসুবিধে হতে পারে যদি তার চিকিৎসা না হয়। এই ব্যাপারে বেঙ্গালুরুর এ্যাপেলো হাসপাতালের পরামর্শদাতা বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ডা. স্টিভ পল মানজালি ‘হ্যাপিয়েস্ট হেল্থ’-কে জানিয়েছেন – ভেস্টিবুলার সমস্যাজনিত পড়ে যাওয়া লক্ষ্য করা যায় ৭৫ বছরের বেশী বৃদ্ধদের মধ্যে । আবার ৬০ বছর বয়সী যদি রক্তচাপ বা মধুমেহর মত একাধিক অসুখ ইতিমধ্যেই থাকে, তাহলে তাঁদের মধ্যে ভেস্টিবুলার সমস্যার ঝুঁকি ৭৫ বছর বয়সীর অন্য অসুখ না থাকা ব্যক্তিদের থেকেও বেশী ।
ভেস্টিবুলার পদ্ধতি সম্পর্কে জানুন
ভেস্টিবুলার সমস্যা আসলে ভেস্টিবুলার পদ্ধতির সমস্যা । এটা একটি ওটোনিউরোলজিকাল বা কান ও স্নায়বিক পদ্ধতি যা কানের ভিতরভাগ এবং স্নায়বিক পথের যোগসূত্র যা মস্তিস্কে পৌঁছোয় । এটা ভারসাম্য বা মাথা ও শরীরের স্থানিক অবস্থান (প্রোপ্রিওসেপশন) নিয়ন্ত্রণ করে ।
বলা যায় কানের অভ্যন্তরের অংশ যেমন সেমিসার্কুলার ক্যানালস (যা কৌণিক গতি নির্ধারণ ও মাথার নড়াচড়ার ভারসাম্য বজায় রাখে), ওটোলিথ অর্গানস (যা সামনে-পেছনে, বাঁদিক-ডানদিকে, ওপর-নীচের গতিবিধির সনাক্ত করতে সাহায্য করে), ওটোকনিয়া (ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের স্ফটিক যা হেয়ার সেলকে সরল গতি দেয়) এবং ভেস্টিবুলার নিউক্লিয়াস (কানের অভ্যন্তরের অংশ চোখের প্রতিবর্তী গতিবিধিতে যার ভূমিকা) ভারসাম্য বা ভারসাম্যহীনতা নির্ধারণ করে ।
ভেস্টিবুলার পদ্ধতি ঠিকঠাক কাজ করছে বলা যায় যদি কেউ পড়ে যাওয়া বা মাথা ঘোরার ভয় না পেয়ে দৈনন্দিন এই কাজগুলো করতে পারে –
- ওপরনীচ বা বাঁদিক ডানদিকে মাথা নাড়ানো
- সিঁড়ি বেয়ে ওপরে বা নীচে যাওয়া আসা
- গাড়ি বা বাইক চালানো
- কাবার্ডের উঁচু তাক থেকে কোন জিনিস নামিয়ে আনা
শরীরের ভারসাম্যহীনতার একটি বিশেষ উদাহরণ
৬২ বছরের শান্তা রাও (নাম পরিবর্তিত) ম্যাঙ্গালুরুতে সুখী অবসরকালীন জীবন যাপন করছিলেন । হঠাৎ মাথা ঘোরা সমস্যা শুরু হয়, যার ফলে তিনি ডানদিকে বা বাঁদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখা বা নিচু হয়ে মেঝে কিছু তোলা ইত্যাদি করতে পারছিলেন না ।
তিনি এটাকে খাওয়া বা আবহাওয়াজনিত কোনও কারণে ঘটা সাময়িক অবস্থা বলে ধরে নিয়ে দোকানে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে সান্ধ্যভ্রমণ ইত্যাদি বন্ধ করে দিয়ে ভাবলেন বাড়িতে বিশ্রাম করলেই ঠিক হয়ে যাবে ।
কিন্তু মাথা ঘোরা পরবর্তী দু সপ্তাহেও কমলো না । বন্ধুদের পরামর্শ মত তিনি স্নায়ু, কান-নাক-গলা, অস্থি এবং এন্ডোক্রিনোলজির চিকিৎসক দেখালেন ।
‘হ্যাপিয়েস্ট হেল্থ’-কে রাও বলেছেন – “মাথা ঘোরা আমার চলাফেরা কয়েকদিনের জন্য কমিয়ে দিয়েছিল । একা একা ঘুরতে সাহস পেতাম না । চিকিৎসকরা বললেন আমার ভার্টিগো হয়েছে । আমাকে ৬ টি করে ট্যাবলেট খেতে হলো । একমাস ধরে আমার ডায়াবেটিসের ওষুধের সঙ্গে এই ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি এবং হাঁটার সময়ে ঘাড়ে কলার পরে হাঁটছি ।”
২০০৬ সালে ব্রাজিলিয়ান জার্নাল অফ ওটোরাহিনোল্যারিঙ্গোলজি-তে প্রকাশিত ‘ক্লিনিক্যাল এভ্যালুয়েশন অফ এল্ডারলি পিপল্ উইথ ক্রনিক ভেস্টিবুলার ডিজঅর্ডার’ লেখায় বলা হচ্ছে – ভেস্টিবুলারে ত্রুটি হলে মাথা ঘোরা বা ভার্টিগো, কানে কম শোনা, ভোঁ ভোঁ শোনা, শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, হাঁটাচলায় অসুবিধে, মাঝে মাঝে পড়ে যাওয়া – ইত্যাদি হতে পারে ।
ভেস্টিবুলার ইমব্যালান্সের বিপদ সংকেত
ডা. অধিকারী ভেস্টিবুলার পদ্ধতির সমস্যার কয়েকটি লক্ষণ বলেছেন –
- মাথা ঘোরা (ভার্টিগো – যখন শরীর বা পারিপার্শ্বিক ঘুরতে থাকে)
- অস্থিরতা
দীর্ঘস্থায়ী বা তীব্র মাত্রায় এর সঙ্গে যোগ হতে পারে
- বমি
- দাঁড়ানো বা হাঁটার অক্ষমতা
ভেস্টিবুলার সমস্যার শরীরতত্ব
শারীরিক পরীক্ষার সিদ্ধান্ত এই যে কানের অভ্যন্তরের উপাদানগুলির ক্ষয় সমস্যার অন্যতম কারণ ।
‘দ্য এজিং ভেস্টিবুলার সিস্টেম : ডিজিনেস এন্ড ইম্ব্যালান্স ইন দ্য এল্ডারলি’ সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, দশ বছর অন্তর ভেস্টিবুলার হেয়ার সেল কমতে থাকে । ভিতরের কানের অর্ধবৃত্তাকার নালির হেয়ার সেল আগে শুকিয়ে যায় তার পর ওটোলিথ অর্গানের হেয়ার সেলের ক্ষয় হয় ।
এছাড়া ২০১২ সালে আমেরিকান এজিং এ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে – বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অটোকোনিয়া, হেয়ার সেল, ভেস্টিবুলার নার্ভস এবং ভেস্টিবুলার নিউক্লিয়াসের সেল-এর ক্ষয় হয় ।
ডা. অধিকারী ব্যাখ্যা করেছেন, বয়স্কদের এই ক্ষয় থেকে হতে পারে বেনাইন প্যারেক্সিসম্যাল পজিশনাল ভার্টিগো (বিবিপিভি)(ভিতরের কানের অর্ধবৃত্তাকার নালিতে উপাদানের স্থান পরিবর্তনে যা হয়), ভেস্টিবুলার নিউরোনাইটিস (ভিতরের কানের ভেস্টিবুলার স্নায়ুর সংক্রমণে যা হয়) অথবা মেনিয়েরস্ ডিজজ (যা ভেতরের কানের ঝিল্লি গোলকধাঁধাঁর দুর্বলতা থেকে হয়) ।
এই অবন্থাগুলো মাথা ঘোরা, পড়ে যাওয়া বা হাঁটাচলার অস্বাভবিকতা বাড়িয়ে দেয় ।
একসঙ্গে থাকা অন্য যে সব রোগ ভেস্টিবুলার অস্বাভাবিকতা বাড়ায় সেগুলি হল – শোনা বা দেখার অসুবিধে, স্মৃতি সংক্রান্ত সমস্যা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ – জানিয়েছেন ডা. মানজালি ।
সমাধান ও চিকিৎসা
একমাস ক্রমাগত মাথা ঘোরা সহ্য করে রাও শেষ অবধি একটি ভেস্টিবুলার স্পেশ্যালিটি ক্লিনিকে যান । ম্যাঙ্গালুরুর ডা. অধিকারী – যিনি রাও-এর চিকিৎসা করেছিলেন – ভার্টিগো বলেই রোগ নির্ণয় করেন এবং জানান, প্রথম দফায় রাও-এর চিকিৎসা ছিল ভেস্টিবুলার সংশোধন ব্যায়াম এবং কয়েকটি ওষুধ । তিন সপ্তাহের মধ্যে অবস্থার উন্নতি হয় । তিনি এখন স্বাধীনভাবে আত্মবিশ্বাস নিয়েই ঘোরাফেরা করছেন ।
ডা. অধিকারী অনেকেরই ভার্টিগো ও ভেস্টিবুলার ত্রুটির চিকিৎসা করেছেন । তাঁর মতে – ভার্টিগো তীব্র হলে সাধারণত: ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা করা হয় । বিপিপিভি জনিত কারণে হওয়া পেরিফেরাল ভার্টিগো সারে বিশেষ যত্ন ও প্রক্রিয়ায় (বিশেষ করে এপলি ম্যানুভার, যেটা এক ধরণের ক্যানালিথ রিপজিশনিং এক্সারসাইজ)
অন্যান্য অবস্থায় নির্দিষ্ট ভেস্টিবুলার রিহ্যাবিলিটিশন প্রোগ্রাম প্রয়োজন যেটা বিশেষজ্ঞ ভার্টিগে ক্লিনিকে করতে হবে যেখানে প্রতিবর্তী চোখের নড়াচড়ার মত পরীক্ষা, যেমন ভিডিওনিস্ট্যাগমোগ্রাম (ভিএনজি) করা সম্ভব – তিনি জানিয়েছেন ।
ভেস্টিবুলার রিহ্যাবিলিটিশন (ভি. আর.) ব্যায়াম নির্ভর চিকিৎসা । কোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ডা. বুয়ান ইন হান, ডা. হুন সেওক সং এবং ডা. জি. সু. কিম বলেছেন, এই চিকিৎসার মধ্যে আছে –
- বারবার শরীরের বিভিন্ন ভঙ্গীতে মাথা ও চোখের চালনা
- কম ভর দিয়ে মাথা ও দেহের বিভিন্ন অবস্থানে ভারসাম্য ঠিক রাখা
- শরীরের উপরিভাগ দিয়ে কাজ করার প্রশিক্ষণ
- যে অবস্থায় মাথা ঘোরে, সেইভাবেই বারবার গতিবিধি করা
লক্ষ্য :
- দৃষ্টি ও ভঙ্গীর স্থিতিশীলতা
- ভার্টিগো ও দৈনন্দিন কাজের উন্নতি
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভি. আর চিকিৎসা বয়স্কদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় আর উদ্বেগ কমায় ।
গ্রহণ করা, অভ্যাস করা, বিকল্প ব্যবস্থা এবং ভেস্টিবুলার ক্ষতিপূরণ (ভারসাম্য বজায় এবং হাঁটাচলার ব্যায়াম) ভি আর-এর মূল তত্ত্ব – মতামত এজিং ক্লিনিক্যাল এ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল রিসার্চ (২০১৫)-এ প্রকাশিত নিবন্ধ ‘এফেক্টস্ অফ ভেস্টিবুলার রিহ্যাবিলিটেশন ইন দ্য এল্ডারলি’-এর ।
ডা. মানজালি বয়স্কদের নিয়মিত ভি. আর ব্যায়ামের পরামর্শ দিচ্ছেন সমস্যার প্রতিরোধে । তাঁর মতে – চলমান একটি বস্তুর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকা বা ঘাড়ের জন্য ওপর নীচে ঘাড় নাড়িয়ে দেখা ইত্যাদি ব্যায়াম খুবই উপযোগী ।
যদিও তাঁর মতে চিকিৎসকের নির্দেশেই এগুলো করা উচিত । সার্ভিকাল স্পন্ডিলোসিস-এর বা অন্য কোনভাবে ঘাড়ে জখম পাওয়া ব্যক্তির এই ব্যায়াম করা উচিত নয় । কারণ এবং প্রতিরোধ নিয়ে ডা. অধিকারীর মত – ভেস্টিবুলার সমস্যা অনেক সময়ই স্ট্রোকের কারণে হতে পারে । তাই ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা এবং ধূমপান থেকে বিরত থাকা সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে ।
তিনি আরো বলেছেন – বয়স্কদের মধ্যে প্রচলিত ভার্টিগো বিপিপিভি নিয়ন্ত্রণ করা যায় অনেক সময় ধরে ঘাড়ের নড়াচড়া বন্ধ না রেখে, বিপজ্জনকভাবে বাইক না চালিয়ে অথবা প্রচন্ড অ্যারোবিক এক্সারসাইজ না করে. ডায়াবেটিস সম্পর্কে ডা. মানজালি বলেছেন – এই অবস্থা এ্যাথোরোস্কিলোসিস (চর্বিজমার জন্য ধমনীর রুদ্ধতা) বা স্নায়ুর ক্ষয়ের জন্য ।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ভেস্টিবুলার কর্মহীনতা কমায় । নিয়মিত বার্ধক্য মূল্যায়ন – যার মধ্যে চোখ ও কান নাক গলা পরীক্ষা – করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ৬০ বছর অতিক্রান্তদের বা যাদের অনেকরকম অসুখের সঙ্গে সহবাস ।