লালচে চুলের জন্য রাজু সিং-কে সবাই ‘লালা’ নামে ডাকে। বজবজের একটা জুটমিলে শ্রমিকের কাজ করেন রাজু। মাধ্যমিক ফেল (ক্লাস টেন)। তারপর আর পড়াশোনা করেননি রাজু। ওই সময়ই শখ করে চুলে লাল রং করেছিলেন। তাঁর সেই হেয়ার স্টাইল বন্ধুদের মধ্যে এতটাই সাড়া ফেলে দিয়েছিল, যে জীবনে আর কখনও লাল চুল কালো করার কথা ভাবেননি রাজু। তবে, তাঁর চুলের রং কখনও কখনও একটু ফিকে হয়ে যায় এই যা। মোটামুটি দেড় থেকে দু’মাস অন্তর চুলে রং করান রাজু। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই এক গুরুতর সমস্যায় পড়েছেন লালা থুড়ি রাজু। ক্রমশ মাথার চুল কমে আসছে। এই মাত্র 24 বছর বয়সেই যেন রাজুর গোছ করা চুলের এক পাশ থেকে উঁকি মারছে টাক!
এখানেও এক বড় সমস্যা। কম বয়সে এত চুল উঠে গিয়েছে দেখে বন্ধুরা এখন তাঁকে টেকো বলে ডাকছেন। মন ভাল নেই তাঁর, মেজাজ বিগড়ে থাকছে যখন-তখন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা তো দূরস্ত, রীতিমতো তাঁদের এড়িয়ে যাচ্ছেন রাজু। চুল ওঠা ঠেকাতে জুটমিলের শ্রমিকের কাজ করে পাওয়া বেতনের সামান্য টাকা দিয়েই নানা রকম শ্যাম্পু কিনে মেখেছেন, কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। শেষে পাড়ার এক দাদার পরামর্শে পুরসভার স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক তরুণ ঘোষের কাছে গেলেন।
শুধু রাজু একা নন, হুগলি শিল্পাঞ্চলের বজবজ, ব্যারাকপুর, নৈহাটি এসব জায়গায় এমন অকালে টাক পড়ে যাওয়া বহু তরুণকে দেখতে পাওয়া যায়। তাঁদের একটা বড় অংশই হিন্দিভাষী। এঁদের বাবা বা ঠাকুরদা পেটের দায়ে বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে এখানে এসে জুটমিলগুলোয় কাজ শুরু করেছিলেন। রাজু’রা সেই ধারাবাহিকতা মেনেই বাঁচছেন। বন্ধুদের কাছে হিরো হওয়ার জন্য এদের অনেকেই মাথায় লাল, সোনালি বা একটু নীলচে রং করে থাকেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বয়স 30 পেরানোর আগেই এঁদের প্রত্যেকের চুল অদ্ভুতভাবে পাতলা হয়ে যায়। প্রতিদিন থোকা থোকা চুল উঠতে থাকে, সঙ্গে বাড়তে থাকে টাকের পরিমাণ। এই টাক ‘যন্ত্রণা’ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য রাজু সিং তো চিকিৎসকের কাছে গেলেন, কিন্তু কোনও উপকার হল কি?
চিকিৎসক তরুণ ঘোষের সঙ্গে এই বিষয়ে আমরা কথা বলি। তিনি জানান, মাঝেমধ্যেই এমন বহু অল্পবয়সী ছেলেরা চুলে ডাই বা রং করার পরে চুল উঠে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে আসছে। শুধুই ছেলেরা কেন! অল্পবয়সী মেয়েরাও হাজির হচ্ছে একই সমস্যা নিয়ে। এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে এদের প্রায় সকলেই দীর্ঘদিন ধরে চুলে রং করছেন।
প্রায় আট বছর ধরে রাজু সিং চুলে রং করে আসছেন। ঠিক এই কারণেই চিকিৎসক ঘোষ জানালেন, অকালে তাঁর টাক পড়ে যাচ্ছে। এই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের কথায়, “চুলের রঙে অ্যামোনিয়া (Ammonia), হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড (Hydrogen Peroxide), পিপিডি (PPD)-এর মতো মারাত্মক সব ক্ষতিকারক উপাদান থাকে। ফলে দীর্ঘদিন মাথার চুলে ডাই বা রং করলে এই সমস্ত উপাদান চুলের গোড়া দিয়ে স্কাল বা মাথার চামড়ার মধ্যে প্রবেশ করে চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি নষ্ট করে দেয়। তার ফলে চুল উঠতে থাকে, চুলের গোড়া রুক্ষ্ম হয়ে ওঠে এবং চুল বড় হওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটাকেই স্তব্ধ করে দেয়। অনেকের মাথায় খুশকির সমস্যা দেখা দেয়। অ্যালার্জির সমস্যা থাকলে চুলের রং বা কলপ থেকে অনেকে শ্বাসকষ্টেও ভোগেন।”
রাজু সিং-এর মতই চুলে রং করে বিপদে পড়েছেন অমল রায়। তাঁর বয়স অবশ্য বছর ৩৭। তিনি একটি কর্পোরেট সংস্থায় চাকরি করেন। বয়স ৩০ পার হতে না হতে হঠাৎই চুলে পাক ধরতে শুরু করে তাঁর। আর তাই বাজারে অতি প্রচলিত একটি কালো হেয়ার ডাই কিনে মাসে একবার করে লাগাতে শুরু করেন। টানা চার বছর এই রুটিন মেনে চলেছেন তিনি। কিন্তু এখন তাঁর এমনই অবস্থা হয়েছে যে, আর হেয়ার ডাই করার দরকারই পড়ছে না। কারণ, চার বছরে মাথার চুল উঠতে উঠতে তা প্রায় গড়ের মাঠের রূপ নিয়েছে ! গত দু’বছর ধরে নানান প্যাক মেখে, অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার দেখিয়েও কোনও লাভ হয়নি। শেষে তিনিও বাধ্য হয়ে চিকিৎসক তরুণ ঘোষের কাছে এসেছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতে। কিন্তু এখানেও তাঁকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে।
অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি কোনও কিছুতেই এই মানুষগুলোর চুলের সমস্যা মিটছে না। কিন্তু কেন? এই প্রশ্ন নিয়ে আমরা জেনারেল ফিজিশিয়ান শেখর রায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। বজবজের এই প্রবীণ চিকিৎসক প্রশ্ন শুনেই আজকের প্রজন্মের চুলের রং করার প্রবণতাকে কাঠগড়ায় তুললেন। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলেন, বুঝেশুনে রূপচর্চা না করলে এমনই ক্ষতি হয়। মারাত্মক সব কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি হেয়ার ডাই দিনের পর দিন মাথায় লাগালে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে!
চিকিৎসক রায় আরও জানান, গত এক বছরে তাঁর কাছে এমন দু’জন রোগী এসেছিলেন যাঁদের চুলের হেয়ার ডাই থেকে শেষ পর্যন্ত ত্বকের ক্যান্সার হয়ে যায়। তাঁর সন্দেহ হওয়ায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ডার্মাটোলজি বিভাগে রেফার করেন। সেখানকার চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানান, স্কিন ক্যান্সার হয়েছে। তাঁর মধ্যে একজনের অবস্থা এতটাই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে ছিল যে, মাস কয়েকের মধ্যে তিনি মারা যান।
চুলে রং করা কেন ক্ষতিকারক?
সাধারণত মানুষজন যেসব ডাই চুলে ব্যবহার করেন, তা ভয়ঙ্কর বললেও কম বলা হয়। বিশেষ করে বাজার চলতি যেসব ডাই কিনতে পাওয়া যায় সেগুলি ব্যবহার করা আর বিষ পান করা সমান!
• চুলে বারবার রং করলে স্কালের স্বাভাবিক লিপিড লেয়ার নষ্ট হয়ে যায়।
• চুলের গোড়া থেকে ময়েশ্চার বেরিয়ে যায়, ফলে আপনার চুল একেবারে রুক্ষ্ম হয়ে ওঠে। আর তারপরেই চুল পড়তে শুরু করে।
• রঙে থাকা পিপিডি, লেডের মত ক্ষতিকারক উপাদানগুলি চুলের গোড়ায় জমা হতে থাকে। এখান থেকে তা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
• রঙে থাকা বিভিন্ন উপাদান থেকে শরীরে অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। তা থেকে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, অ্যাজমার মত অসুখ হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা তৈরি হয়।
• গর্ভবতীদের গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে।
হেয়ার ডাই বা চুলের রং ক্ষতি করার ক্ষমতার ভিত্তিতে মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে। এই বিভাজনটা করা হয়েছে মূলত, তা চুলে কতদিন স্থায়ী হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে। এর উপরই নির্ভর করে তা চুল ও স্বাস্থ্যের কতটা ক্ষতি করছে সেই বিষয়টি।
1) অস্থায়ী রং:
এই ধরনের রংগুলি অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী হয়। চুলের এই রং একবার শ্যাম্পু করলেই উঠে যায়। এই ধরনের হেয়ার ডাই চুলের খুব একটা ক্ষতি করে না, কারণ তা চুলের গোড়ায় প্রবেশ করে না। কেবলমাত্র উপর দিয়ে সাময়িকভাবে চুলের রংটা বদলে দেয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করলে এই ধরনের অস্থায়ী রং থেকেও ক্ষতি হতে পারে।
2) আধা স্থায়ী রং:
চুলের এই ধরনের রং থেকে দীর্ঘস্থায়ী ভিত্তিতে ভালই ক্ষতি হয়। এই রং 8-12 বার শ্যাম্পু করলে তবে চুল থেকে ওঠে। এগুলো মোটেও ভাল নয়। দু-একবার মাথায় দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু বেশিবার করলে চুল নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থেকে যায়।
3) স্থায়ী রং:
এই হেয়ার ডাইগুলোই বাজারে বেশি বিক্রি হয়। এগুলি সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে বলে চাহিদাও বেশি। কিন্তু এই শ্রেণির রংগুলো স্থায়ীভাবে চুলের ক্ষতি করে দেয়। দীর্ঘদিন এই রং ব্যবহার করলে এর মধ্যে থাকা অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, পিপিডি, লেডের মত ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক উপাদানগুলি চুলের গোড়ায় জমা হতে থাকে। সেখান থেকেই অ্যালার্জি, এমনকি ত্বকের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এই রং চুলে দেড় থেকে দু’মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
এছাড়াও উপাদানের দিক থেকে চুলের রং বা হেয়ার ডাই-কে আরও তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
1) ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক চুলের রং:
হেনা জাতীয় জিনিস এই শ্রেণির মধ্যে পড়ে। অনেকের ধারণা, এগুলো চুলের ক্ষতি করে না। কিন্তু এই ধারণার কোনও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। বরং, লাগাতার হেনা করলে সেটাও একইভাবে আপনার চুলকে নষ্ট করে দিতে পারে।
2) কেমিক্যাল চুলের রং:
এই ধরনের চুলের রং দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে ব্যবহার করলে চুল এবং বাকি স্বাস্থ্যের ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। বাজারে এই ধরনের হেয়ার ডাইয়ের দাম কিছুটা বেশি।
3) সিন্থেটিক রং:
সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যে চুলের রং, কলপ বা হেয়ার ডাইগুলো দেখা যায় সেগুলো মূলত এই শ্রেণির হয়ে থাকে। এগুলো ভয়াবহভাবে চুল এবং বাকি স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
তাহলে কি চুলে রং করাই যাবে না?
মাথার চুলকে তার স্বাভাবিক ছন্দে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ। তাঁরা খাঁটি নারকোল তেল, শ্যাম্পু, কন্ডিশনারের মত জিনিস ছাড়া অন্য কিছু চুলে ব্যবহার করতে নিষেধ করছেন। তারপরেও অনেকের চুলের রং করতে ইচ্ছে হতে পারে। বিশেষ করে যাঁদের চুল পেকে যাচ্ছে বা সাদা হয়ে যাচ্ছে, তাঁদের এই ইচ্ছে হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে কয়েকটি জিনিস মাথায় রেখে চুলের রং করলে সমস্যা বা বিপদ থেকে সামান্য হলেও মুক্তি পাওয়া যাবে।
• 6%-এর কম পিপিডি আছে এমন হেয়ার ডাই ব্যবহার করুন। যদিও তা পাওয়া বেশ মুশকিল। কারণ স্পেনের মতো উন্নত দুনিয়ার দেশেও দেখা গিয়েছে হেয়ার ডাইতে 10%-এর বেশি পিপিডি থাকছে।
• চুলে কলপ বা হেয়ার ডাই করার আগে ভাল করে কন্ডিশনার লাগিয়ে নিন। সেই সঙ্গে ভিটামিন-সি ক্যাপসুল খান।
• ভুলেও দীর্ঘ সময় রং ধরে রাখবে এমন স্থায়ী হেয়ার ডাই লাগাবেন না। একবার শ্যাম্পু করলেই উঠে যাবে, এমন রঙের দিকে নজর দেওয়া ভাল।
• অ্যালার্জি থাকলে চুলে রং করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সবশেষে একটাই কথা বলার, সুস্থভাবে বাঁচাটা খুব জরুরি। চুলের রং নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্তু তা ঠিক করতে গিয়ে আরও বড় বিপদ ডেকে আনাটা উচিত নয়। তাই কোনও পদক্ষেপ-এর আগে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নিন।