ছিলেন বড্ড উদাসীন। আর পাঁচটা কলেজ পড়ুয়ার মতো একদিন কলেজ মিস হলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত! সালটা 1995। মৌসুমী পাঠক তখন গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। কলেজের এই সময়টায় তিনি লক্ষ্য করেন, রোজ হাঁচি হচ্ছে। সঙ্গে নাক দিয়ে ক্রমাগত জলও পড়ছে। শুধু তাই নয়। পাল্লা দিয়ে গা-হাত-পায়ে চুলকানিও হচ্ছে। কেন এমনটা হচ্ছে, বুঝতে পারছিলেন না মৌসুমী? অসমের আর্দ্র গ্রীষ্মের কারণেই কি তাঁর সঙ্গে এমনটা হচ্ছিল, ঘাবড়ে গিয়েছিলেন তিনি।
মৌসুমী পেশায় একজন বিহু (অসমীয়া লোক নৃত্য) নৃত্যশিল্পী। সে সময়ই যখন ঘনঘন হাঁচি, গা-হাত-পায়ে চুলকানি তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে যায়, মৌসুমী সিদ্ধান্ত নেন স্থানীয় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার। হ্যাপিয়েস্ট হেলথের তরফে মৌসুমীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “অ্যালার্জি আমার জীবনে বিনবুলায়ে মেহমানের মতো দেখা দিয়েছিল। সেই সময় আমি ভাবতেও পারিনি যে, আমার স্বাভাবিক জীবনকে অ্যালার্জি কতটা সমস্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে।”
একটা মানুষের 35টি ভিন্ন অ্যালার্জি
জীবন কেটে যাচ্ছিল অ্যালার্জিকে সবসময়ের সঙ্গী করে। অ্যান্টি-অ্যালার্জি ওষুধ এবং নাজ়াল ড্রপের উপরে ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন মৌসুমী। তিনি বলেন, “অ্যালার্জি আমাকে সবসময় ক্লান্ত ও অবসন্ন করে তুলছিল। হঠাৎ কী করে আমার সঙ্গে এমনটা ঘটে গেল, কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।”
একাধিক ডাক্তারের পরামর্শ নেন। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। শেষমেশ অ্যালার্জির মতো এমন সমস্যার সমাধানসূত্র খুঁজতে দিল্লির উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। সেখানে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস (এআইআইএমএস)-এ গিয়ে ডাক্তার দেখান মৌসুমী। ফোন কলেই একটু কাশতে-কাশতে তিনি বললেন, “35টি ভিন্ন ভিন্ন অ্যালার্জেনের টেস্ট পজ়িটিভ আসে আমার। ডাক্তাররাও আমার মতো অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, অ্যালার্জি সম্পূর্ণ ভাবে সারানোর কোনও রাস্তা নেই। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সব অ্যালার্জিগুলিকে পরিচালনা করতে হবে। সত্যি কথা বলতে গেলে কী, ওই সময়টায় আমি খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।” মৌসুমী জানালেন, এত সংখ্যক অ্যালার্জেনের রিপোর্ট পজ়িটিভ এসেছিল তাঁর, সেই সবের নামই মনে করতে পারেন না।
মরসুমী অ্যালার্জি তাঁকে আরও ভোগাচ্ছিল
মৌসুমী পাঠকের অ্যালার্জির অন্যতম প্রধান দুটি অ্যালার্জেন হল ধুলো এবং পোলেন। তাঁর কথায়, “গুয়াহাটির রাস্তায় সবসময় ধুলো-বালি থাকে। দিনের বেলায় এখানে রাস্তায় বেরোনো আমার জন্য মোটেই ভাল নয়। যদি কোনও কারণে আমাকে বাইরে যেতেও হয়, তাহলে অ্যালার্জির ট্যাবলেট খেতে হয়।” হাসতে-হাসতে আরও যোগ করে বললেন, “আমি বন্ধুদের মধ্যে সেরকম একজন হিসেবে পরিচিত, যে সর্বদাই হাঁচতে থাকে।”
“কিন্তু আমার জন্য বছরের সবচেয়ে খারাপ সময় হল যখন ঋতু পরিবর্তন হয়। সিজ়ন চেঞ্জের সময় আমাকে অ্যালার্জিতে ব্যাপক ভাবে ভুগতে হয়,” বললেন মৌসুমী। কীভাবে তাঁর অ্যালার্জি প্রকাশ পায় সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর উত্তর, “বেশিরভাগ সময়েই হাঁচি হয়। তার সঙ্গে কখনও আবার কাশি, চুলকানিও হয় এবং চোখে জল বেরোতে থাকে।”
তবে তাঁর অ্যালার্জি তাঁকে একাধিক পছন্দের কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। মৌসুমী চাইলেই তাঁর প্রিয় ফুলটা একবার ছুঁয়ে দেখতে পারেন না। আবার চাইলে মনপসন্দ সবজিটাও হাত দিয়ে দেখতে পারেন না। একটু মন খারাপের সুরেই যোগ করলেন, “এইমস-এর ডাক্তাররা আমাকে এমনই কিছু শাকসবজি খেতে বারণ করেছেন, যেগুলো আমি ছোট থেকে খেয়ে বড় হয়েছি। তার কারণ, সেই সব শাকসবজি খেলে অ্যালার্জি বাড়তে পারে।”
তারপর তিনি খাদ্যতালিকা থেকে বেগুন, ফুল, ফ্রেঞ্চ বিনস, লং বিনস, শসা, হাঁস বা পায়রা দিয়ে তৈরি উপাদেয় খাবার, কলোকেসিয়া পাতা, এলিফ্যান্ট অ্যাপল বা চালতা, কিডনি বিনস, বরবটি এবং ঢেঁড়শের মতো একাধিক সবজি বাদ দিয়ে দেন।
অ্যালার্জি ও হাঁপানি
দিল্লির ডাক্তাররা মৌসুমীকে বলেছিলেন, অ্যালার্জির এই প্রবণতা তাঁকে হাঁপানির দিকে নিয়ে যেতে পারে। কয়েক বছর পর দেখা গেল, সেটাই সত্যি। মৌসুমীর কথায়, “ছোট থেকে দেখে আসছি, শীতের রাতে আমার পরিবারের সকলেই আগুনের কাছে গিয়ে বসেন। এটা একটা ঐতিহ্যও বটে। কিন্তু আমার হাঁপানি হওয়ার পরে তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, সামান্য ধোঁয়ায় আমার কাশি হয় এবং শ্বাস নিতে খুবই সমস্যা হয়।”
বছর কুড়ি পরে মৌসুমীর অ্যালার্জি আরও খারাপ আকার ধারণ করতে থাকে। তাঁর কথায়, “আমি যে অ্যান্টি-অ্যালার্জি ওষুধগুলি খেতাম, সেগুলোর স্বাভাবিক ডোজ়ই এখন আর কার্যকর নয়। বিগত কয়েক বছরে ডাক্তার আমার ডোজ় কিছুটা বাড়িয়েছে। যার ফলে, আমার মাথা ঘুরতে থাকে, তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকি এবং ওজনও কিছুটা বেড়েছে।”
বিহু নাচই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে
সেই কলেজে পড়াশোনার সময় থেকেই বিহু নাচ শুরু করেছিলেন মৌসুমী। অ্যালার্জি তাঁকে যতই সমস্যার দিকে ঠেলে দিক না কেন, নাচ থেকে দূরে সরে যেতে দেয়নি। বরং, নাচই তাঁকে এই বিরক্তিকর অ্যালার্জির হতাশা থেকে সামান্য আনন্দের স্বাদ দিয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ম্যারাথন দৌড় এবং বিহু নাচের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ওয়ার্কশপের আয়োজন করা তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে।