হাইড্রেটেড থাকার জন্য আপনি যে পরিমাণ জল পান করেন তা কি আপনি পরিমাপ করেন? মজার বিষয় হল, আপনি যদি মনে করেন যে এটিই আপনার হাইড্রেশনের মাত্রাকে পরিমাপ করার সঠিক উপায়, তবে আয়ুর্বেদের এই বিষয়ে এক আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, চুমুক দিয়ে জল পান করে আপনি যে দৈনিক ৩-৪ লিটার জল পান করার মানদন্ড পূরণ করেছেন তা নিশ্চিতকরণ আপনার জন্য খারাপ হতে পারে।
হ্যাপিয়েস্ট হেলথ বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছে আয়ুর্বেদ অনুসারে জল পান করার পদ্ধতি। যা আপনাদের জল খাওয়ার নিয়ে এক স্বচ্ছ ধারণা দেবে।
‘আপনার শরীরকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন’
কর্ণাটকের মুডবিদ্রির আলভা’স আয়ুর্বেদ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডঃ ঘনশ্যাম বি শর্মা এই সত্যটি তুলে ধরেছেন যে আয়ুর্বেদ কখনই আপনাকে দিনে কতটা জল পান করেন তার পরিমাপ করতে বলে না। একই সাথে, তিনি আরও বলেন যে কারুর শরীরকে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত যে তার কতটা জল প্রয়োজন।
“আপনার শরীর আপনাকে তৃষ্ণার সংকেত দেয়। আপনাকে যা করতে হবে তা হ’ল আপনার শারীরিক চাহিদাগুলি শোনা এবং সেগুলিকে পূরণ করা,” ডাঃ বি শর্মা আরও জানান।
কাস্টমাইজড পদ্ধতি
সবার একই মাত্রায় জল পান করার প্রয়োজন হয় না। বয়স, ঋতু, জীবনধারা (অলস বা সক্রিয়) বা অন্তর্নিহিত চিকিৎসা শর্ত অনুসারে এই প্রয়োজনীয়তা পরিবর্তিত হয়।
যে ব্যক্তির বিপাক দ্রুত (পিত্ত দেহের ধরণ) তার বেশি জল পান করার প্রয়োজন হতে পারে, অন্যদিকে ধীর বা মন্থর বিপাক (কাফ দেহের ধরণ) যুক্ত ব্যক্তির জল পান করার প্রয়োজন কম হতে পারে।
এছাড়াও, গ্রীষ্মকালে কারুর অতিরিক্ত জল পান করার চাহিদা হতে পারে তবে শীতকালে আবার সেই চাহিদাই কম হয়ে যাবে।
খাবার খেতে খেতে জল পান করা উচিত অথবা উচিত না?
যদিও খাবার খেতে খেতে জল পান করা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে, গুজরাটের আয়ুর্বেদিক প্র্যাকটিশনার ডঃ হেমন্ত শর্মা বলেছেন যে খাবার খেতে খেতে জল পান করলে তা খাবারকে সহজে বিভাজিত করতে এবং হজম করতে সহায়তা করে।
“যখন কেউ খাবার খাওয়ার পরে জল পান করে, তখন তা শরীরের ওজন বাড়িয়ে তোলে। আয়ুর্বেদ বলছে, খাবার খাওয়ার পরপরই হজমের প্রথম পর্যায় শুরু হয়। এই পর্যায়ে জল খাওয়ার ফলে পুষ্টির অসংগঠিত সংমিশ্রণ হতে পারে যা আমাদের শরীরকে অতিরিক্ত ওজন বাড়ানোর দিকে বা স্থূলত্বের দিকে নিয়ে যায়, “ডাঃ শর্মা বলেন।
“খাবার খাওয়ার আগে জল পান করা উচিত নয় কারণ এতে ক্ষিদে কমে যায়। এই অভ্যাসটি আমাদেরকে শরীরকে রোগা করে তোলে”, তিনি আরও বলেন।
কোরিয়ার জিওনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা খাবার খাওয়ার আগে জল খাওয়ার প্রভাবকে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁরা দেখেছেন যে খাবারের আগে জল পান করার অভ্যাসটি আমাদের শরীরের খাবার থেকে শক্তি গ্রহণ করার পরিমাণকে কম করে। তাঁরা পরামর্শ দেন যে খাবার আগে জল পান করার অভ্যাসটি আপনার ওজন খেয়াল রাখার জন্য একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে।
আয়ুর্বেদও সুপারিশ করে যে আমাদের খাবারের এক চতুর্থাংশে জল/তরল থাকা উচিত এবং অর্ধেক অংশে যথাযথভাবে শক্ত/আধা-শক্ত খাবার থাকা উচিত এবং বাকি এক চতুর্থাংশকে বায়ু চলাচলের জন্য মুক্ত রাখা উচিত।
উষ্ণ বনাম ঠান্ডা জল
ডাঃ বি শর্মা স্পষ্ট করেন যে আয়ুর্বেদ ঠান্ডা/বরফযুক্ত জলের ব্যবহার করতে বলে না কারণ তা হজমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, কেউ যদি অতিরিক্ত তৃষ্ণার্ত হয়, ক্লান্তি বোধ করে, বমি করে, মদের নেশায় চুর হয়ে থাকে, জ্বালার অনুভূতি হয় তবে তাদেরকে এবং গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা জল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
যাদের বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, বা কফের কারণে শারীরিক দুরবস্থা (জল এবং মাটির উপাদানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা) আছে তাদের এবং শীতকালে হালকা গরম জল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এটি হজমের ক্ষেত্রে সহায়ক হিসাবেও বিবেচিত হয়।
পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পানের উপকারিতা
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC) প্রতিদিনের মোট যে পরিমাণ জল আমরা গ্রহণ করি সেই পরিমাণকে খাবার থেকে পাওয়া জল, পানীয় জল, এবং অন্যান্য পানীয় থেকে পাওয়া জলের পরিমাণের দ্বারা ব্যাখা করে। আপনার হাইড্রেশনের লেভেলটি শুধুমাত্র আপনি কতটা জল পান করেন তার উপরেই নির্ভর করে না, জলের পরিমাণ বেশি আছে এমন ফল এবং শাকসব্জী খাওয়ার উপরেও নির্ভর করে। শরীরের হাইড্রেশন লেভেলকে পূরণ করার সহজতর উপায় হল জল পান করা কারণ এতে ক্যালোরি শূন্য।
হাইড্রেশন লেভেল শারীরিক কর্মক্ষমতা বাড়ায়। জল গ্রহণ একজনের স্মৃতিশক্তি এবং জ্ঞানকেও প্রভাবিত করতে পারে। উল্টোদিকে, ডিহাইড্রেশন কোনও ব্যক্তির মেজাজ এবং জ্ঞানীয় আচরণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
কিডনি রক্ত পরিস্রাবণে অবদান রাখে। রক্ত প্রবাহ থেকে বর্জ্য পরিস্রাবণের জন্য এই অঙ্গটির জলের প্রয়োজন হয় এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে সেই তরল বর্জ্যের নির্গমন ঘটে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পান করা জল শরীর থেকে বর্জ্য এবং টক্সিনকে যথাযথভাবে বের করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে।
রক্তের পরিমাণ, রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দনও, পান করা জলের এবং শরীর থেকে বের করা তরল বর্জ্য পদার্থের পরিমাণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
ফ্রান্সের গবেষকরা খুঁজে বার করেছেন, যারা অভ্যাসগতভাবে স্বল্প পরিমাণে মদ্যপান করেন তারা জল খাওয়ার পরিমাণ বাড়ানোর ফলে তাদের মেজাজ ভাল হতে শুরু করে, ক্লান্তি, বিভ্রান্তি দূর হতে শুরু করে এবং ঘুম ভাল হতে শুরু করে। অভ্যাসগতভাবে যারা বেশি পরিমানে মদ্যপান করেন তারা জল খাওয়ার পরিমাণ কম করার ফলে তাদের মেজাজ নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে শুরু করে। তারা নিজেদের কম শান্ত রাখতে পারে এবং তাদের আবেগ কম ইতিবাচক। গবেষণায় জলের বেসলাইন উচ্চমাত্রায় ২.৫ লিঃ/প্রতিদিন এবং নিম্নমাত্রায় ১ লিঃ/প্রতিদিন হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
জল পান করার জন্য আয়ুর্বেদিক টিপস
১। জল দিয়ে আপনার দিন শুরু করুন: সূর্যোদয়ের আগে সকালের প্রাত্যহিক কাজগুলি সারার পর সর্বপ্রথম জিনিস হিসাবে জল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। খালি পেটে প্রায় ৬৪০ মিলি লিটার জল পান করতে হয়। এটি বিষাক্ত পদার্থগুলিকে বের করতে সহায়তা করে।
২। যখনই তেষ্টা পাবে তখনই জল পান করুন: আয়ুর্বেদ তৃষ্ণা বা তেষ্টাকে অদমনীয় আকাঙ্ক্ষাগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচনা করে। তেষ্টা লাগলে সঙ্গে সঙ্গে জল পান করুন।
৩। একবারে কখনই ঢকঢক করে জল পান করবেন না: একবারে ঢকঢক করে এক বোতল জল পান করলে তা আপনাকে বদহজম/ক্ষিদে কম করার দিকে ঠেলে দেয়।
৪। ঠাণ্ডা জল পান করা এড়িয়ে চলুন: আয়ুর্বেদ ঠাণ্ডা জল পান করার কঠোর বিরোধিতা করে কারণ এটি হজম ক্ষমতাকে কম করে।
৫। ঋতু অনুযায়ী জল পান করুন: ঋতুর উপর ভিত্তি করে জল পান করার পরিকল্পনা করা উচিত কারণ গ্রীষ্মে, শরীরের যেখানে বেশি পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয় সেখানে শীতকালে কম পরিমাণে জলের প্রয়োজন কম হয়।