বাড়িতে তৈরি খাবার-দাবারে কি আপনি প্যাকেটজাত মশলা দেন? কত বড় বিপদ ডাকছেন, কোনও ধারণা আছে? তাহলে জেনে রাখা ভাল, প্যাকেটের মশলায় ইথিলিন অক্সাইড নামক যে রাসায়নিক থাকে, তা কার্সিনোজেন বা একটি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী এজেন্টে ভরপুর। বেঙ্গালুরুর অ্যাস্টার সিএমআই হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েটেটিক্সের হেড অব সার্ভিসেস ডাঃ এডউইনা রাজ বলেন, “অল্প সময়ের জন্য মানুষ এই ক্ষতিকারক পদার্থের (ইথিলিন অক্সাইড) সংস্পর্শে এলে মাথাব্যথা, বমি-বমি ভাবের মতো একাধিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।” আরও ভয়ঙ্কর দিকের কথা উল্লেখ করে তিনি বললেন, দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের ফলে ডিএনএ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ইথিলিন অক্সাইডের উপস্থিতির কারণে সিঙ্গাপুর এবং হংকংয়ের মতো দেশে এমডিএইচ এবং এভারেস্ট মশলা তুলে নেওয়া হয়েছে। এমনকি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভারতে প্রাপ্ত প্যাকেটজাত মশলাগুলির মধ্যে থাকা অন্যান্য বেশ কয়েকটি যৌগ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কেরালার মালাবার ক্যাফের শেফ ডি কুইজ়িন এবং কেরালার কোচির গ্র্যান্ড হায়াতের শেফ কে লাথার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলা হয় হ্যাপিয়েস্ট হেলথের তরফে।
কেরালার প্রথম মহিলা শেফ লতা খাবারে প্যাকেটজাত মশলার পরিবর্তে তাজা উপাদান যোগ করার কথা বলছেন। তাঁর দাবি, গোটা মশলা গুঁড়ো করে দিলে তাতে স্বাদ যেমন বাড়ে, খাবারের স্বাস্থ্য উপকারিতাও বাড়িয়ে তোলে। মশলা ও ভেষজের ব্যবহার ও সংরক্ষণ নিয়ে একাধিক টিপস দিয়েছেন তিনি:
গোটা মশলা দীর্ঘস্থায়ী হয়: গুঁড়ো মশলা কেবল এক বছরের জন্য স্থায়ী হয়। সেই জায়গায় গোলমরিচ, জিরা এবং লবঙ্গের মতো মশলা ভাল করে সংরক্ষণ করা গেলে তা তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
গুঁড়ো করার আগে ভাল করে মশলা শুকিয়ে নিন: আর্দ্রতার কারণে মশলা তাড়াতাড়ি নষ্ট হতে পারে। তাই, মশলা সংরক্ষণের আগে ভাল ভাবে শুকিয়ে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এয়ারটাইট কন্টেইনারে সংরক্ষণ করুন: মশলা শুকিয়ে গেলে এয়ারটাইট পাত্রে রাখুন। দৈনন্দিন রান্নার জন্য খুবই অল্প পরিমাণে পাত্রে আলাদা করে রাখা যেতে পারে। তাতে মশলার বাকি অংশের স্বাদ যেমন ভাল থাকবে, তেমনই আবার মশলাটিকে সহজেই তার স্বাদ হারাতে দেবে না।
শুকনো চামচ ব্যবহার করুন: পাত্র থেকে মশলা নেওয়ার সময় সর্বদা একটি শুকনো চামচ ব্যবহার করুন। মাথায় রাখবেন, এয়ারটাইট বাক্সে ভেজা চামচ ঢোকালে সেখানে আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়তে পারে। ফলে, মশলা তার সতেজতা হারাতে পারে।
আলো এবং তাপ থেকে দূরে রাখুন: মশলা এবং ভেষজ সবসময় তাপ এবং আলো থেকে দূরে সংরক্ষণ করুন, যাতে সেগুলি দীর্ঘ সময়ের জন্য তাজা থাকে।
ইথিলিন অক্সাইড নিয়ে বিতর্কের কারণ
ব্যাঙ্গালোরের সেন্ট জন্স মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক ডাঃ ডেনিস জেভিয়ার বলেন, “ইথিলিন অক্সাইড হল একটি বর্ণহীন গ্যাস যা ইথিলিন গ্লাইকলের মতো রাসায়নিক উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।” সঙ্গে তিনি যোগ করেন, গাড়ি যে কার্বন নিঃসরণ করে তাতে এবং সিগারেটেও এই রাসায়নিকের উপস্থিতি রয়েছে। যদিও, এই গ্যাসের খুব অল্প পরিমাণ ভেষজ এবং মশলার মতো উপকরণগুলি থেকে জীবাণু বের করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
ডাঃ জেভিয়ার বলছেন, কয়েক বছর আগে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) ইথিলিন অক্সাইডকে গ্রুপ-2 ক্যাটাগরির কার্সিনোজেন থেকে গ্রুপ 1-এ উন্নীত করে। যদিও পূর্ববর্তী শ্রেণিবিন্যাসটি ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, এটি ‘সম্ভবত মানুষের জন্য কার্সিনোজেনিক’। দীর্ঘ দিনের অধ্যয়ন এবং প্রমাণের ভিত্তিতেই এই ইঙ্গিত মিলেছিল, যেখানে রাসায়নিকটি স্তন ক্যান্সার এবং রক্তের ক্যান্সারের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
বছরের পর বছর ধরে যান্ত্রিক গবেষণা এবং মানুষ ও প্রাণীদের উপরে গবেষণার পরে মার্কিন পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা (ইপিএ) সম্প্রতি ইথিলিন অক্সাইডকে মানব কার্সিনোজেন হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। এছাড়া প্রায় এক দশক আগে নিউজিল্যান্ডে আমদানি করা মশলাগুলিতে ব্যাপক পরিমাণে ইথিলিন অক্সাইডের উপস্থিতি পাওয়া যায়। 2020 সালের সেপ্টেম্বর থেকে 2024 সালের এপ্রিল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের খাদ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ ভারতের সঙ্গে যুক্ত 527টি পণ্যে ইথিলিন অক্সাইড খুঁজে পায়, যার মধ্যে রয়েছে 313টি বাদাম ও তিলের বীজ, 60টি ভেষজ ও মশলা এবং 48টি ডায়েটিক খাবার।
খাবারে ইথিলিন অক্সাইড ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি
বেঙ্গালুরুর এইচসিজি ক্যান্সার সেন্টারের কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং ডিন (হেড অ্যান্ড নেক সার্জিকাল অনকোলজি অ্যান্ড রোবোটিক সার্জারি) ডাঃ ইউ এস বিশাল রাও বলেন, খাবারের মাধ্যমে ইথিলিন অক্সাইড এবং অন্যান্য কার্সিনোজেনিক উপাদান গ্রহণের ফলে পাকস্থলীর ক্যান্সার, ব্লাড ক্যান্সার (লিউকেমিয়া) এবং স্তন ক্যান্সার-সহ নানাবিধ ক্যান্সার হতে পারে। ডাঃ রাও আরও বলেন, “এই ঝুঁকিগুলি কমাতে এবং সর্বোপরি জনস্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, খাবারের কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপের পাশাপাশি অবহিত ও দায়িত্বশীল ভোক্তাবাদও জরুরি হয়ে পড়েছে।”
রাসায়নিক মুক্ত সংরক্ষণ কৌশল জরুরি
শেফ কে লাথা আরও এক খতরনাক দিকের কথা তুলে ধরলেন। বললেন, অনেক সময় মশলাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে তাতে সিন্থেটিক রং যোগ করা হয়। তিনি আরও জানান, চাষের সময় মরিচে কীটনাশকও স্প্রে করা হয়। তাঁর কথায়, “প্রতিটি সংস্থা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে এই মশলা গুঁড়ো প্রক্রিয়াজাত করে। সেগুলি যাতে বেশি দিন ধরে টেকসই হয়, তার জন্য কেমিক্যাল স্প্রে-ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।”
মশলা কী ভাবে রাসায়নিক মুক্ত করে সংরক্ষণ করা যায়, তা জানা জরুরি
শেফ কে লাথা বলছেন, সুদান ডাই (বিশেষ ধরনের রঞ্জক, যা মূলত লঙ্কা গুঁড়োতে ব্যবহৃত হয়) এবং সিন্থেটিক রং প্রায়শই খাবারের বিভিন্ন পণ্যতে যোগ করা হয়, যার মধ্যে অন্যতম হল মরিচের গুঁড়ো। এই শেফ আরও জানাচ্ছেন যে, মরিচ চাষের সময়ই কীটনাশক স্প্রে করা হয়। “প্রত্যেকটি কোম্পানিই এই মশলা গুঁড়োগুলিকে নিজস্ব পদ্ধতিতে প্রসেস করে। মশলাগুলি যাতে আরও বেশি দিনের জন্য টেকসই হয়, তার জন্য রাসায়নিক স্প্রে-ও যোগ করা হয়,” বললেন তিনি।
তাই, রাসায়নিকমুক্ত ময়দা এবং মশলা গুঁড়ো দীর্ঘস্থায়ী করতে প্রাকৃতিক উপায়ে সংরক্ষণ ও তার কৌশলগুলি জেনে রাখার বিষয়ে বার বারই জোর দিচ্ছেন শেফ লতা। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, চালের আটা তৈরির প্রথাগত প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত শুকানোর আগে চালকে অন্তত সাত বার ধুয়ে এবং পিষে নেওয়া হয়। এছাড়াও, গরম মশলায় দারুচিনি এবং লবঙ্গের মতো উপাদান থাকে যা তাকে খুব দ্রুত নষ্ট হতে দেয় না এবং প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রাকৃতিক ভাবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
প্রাকৃতিক উপায়ে মশলা সংরক্ষণের আরও সহজ পন্থার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন যে, কেউ চালের পাত্রে লবঙ্গ যোগ করতে পারেন, যাতে পোকামাকড় প্রবেশ করতে না পারে। একই রকম ভাবে, শুকনো খাবার এবং মশলা সংরক্ষণেরও অন্যান্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলি মেনে চলা যেতে পারে, তাহলেই মশলা থেকে রাসায়নিকের পরিমাণ কমানো যেতে পারে।
ব্যবসা বৃদ্ধির চিন্তাভাবনা যেখানে উপভোক্তার জন্যই ক্ষতিকারক
ব্যবসা এমনই এক ক্ষেত্র যেখানে প্রায়শই বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও তার দায়িত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, বলছেন ডাঃ রাও। তাঁর কথায়, “খাবারের স্বাদ ও রং বাড়াতে খাদ্য পণ্যে কার্সিনোজেন যোগ করার ফলে খুব সম্ভবত বিক্রিবাট্টা বাড়ে। মানুষও স্বাদের মোহে দোকানে মশলা কিনতে ভিড় বাড়ায়। কিন্তু তাতে আখেরে যে তাঁদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকি তৈরি হয়, তাঁরা তা বুঝতেও পারেন না। এভারেস্ট এবং MDH মশলা পাউডারের মতো পণ্যগুলিতে ইথিলিন অক্সাইড ব্যবহৃত হয়, যা ছত্রাকনাশক লেবেলযুক্ত। তবে খাবারে এর উপস্থিতি যথেষ্টই উদ্বেগ বাড়ায়।” তিনি আরও যোগ করে বলেন, এই উপাদানগুলি ছত্রাকের বেড়ে ওঠাকে বাধা দেয় ঠিকই কিন্তু মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই খারাপ।
ডাঃ রাও বলছেন, “ইথিলিন অক্সাইডের মতো কার্সিনোজেনগুলি ক্যান্সারের বেড়ে ওঠার পক্ষে সহায়ক হয় এবং প্রাথমিক ভাবে সেই অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে, যেখানে সর্বাধিক খাদ্য শোষিত হয়, যেমন পেট, কোলন বা অন্ত্র।”
দায়িত্বশীল কনজিউমারিজম
ডাঃ রাও পরামর্শ দিচ্ছেন যে, মশলাগুলিতে ক্ষতিকারক সংযোজনগুলির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায় হিসাবে জ্ঞাত এবং দায়িত্বশীল কনজিউমারিজম বা ভোগবাদকে সমর্থন করা উচিত। এ বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা, “আইন এবং নৈতিক মানদণ্ডের উপরে নির্ভর করে যে কোনও পণ্যের সত্য তথ্য উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। একমাত্র সেই তথ্যের উপরে ভিত্তি করেই ক্রেতা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, যা তার শরীরের জন্য ভাল হবে।”