গ্রিন জুস নিয়ে চর্চা সর্বত্র। এই পানীয়কে হালফিলের অন্যতম সেরা ‘ফিটনেস বেভারেজ’ বলা হচ্ছে, যা মূলত সেলিব্রিটিদের সৌজন্যে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গিয়েছে। প্রায়শই আমাদের নজরে এমন কিছু ভিডিয়ো আসে, যেখানে তারকাদের এমনতর সবুজ রঙের পানীয় খেতে দেখা যায়। একদিকে এই পানীয় যেমন খুব সহজেই তৈরি করা যায়, আর একদিকে এর একাধিক স্বাস্থ্য উপকারিতাও রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের পানীয়কে ব্যালান্সড্ ডায়েট বা সুষম খাদ্য হিসেবে প্রতিস্থাপিত করা যায় না।
ব্যাঙ্গালোরের অ্যাপোলো হাসপাতালের প্রধান ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান প্রিয়াঙ্কা রোহাতগি বলছেন, কেউ যদি ওয়ার্কআউটের পরে সবুজ জুস এবং স্মুদি খেতে পারেন, তাহলে খুব ভাল উপকারিতা পেতে পারেন। কারণ, এগুলি ডায়েটারি নাইট্রেট এবং নাইট্রাইটের ভাল উৎস। তবে, এই পানীয়গুলি স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে পারে না কারণ এতে আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি মজুত থাকে না।
গ্রিন জুসের উপকারিতা
সবুজ শাকসবজি , পালং শাক, কেলে শাক, শসা এবং বিভিন্ন লেবুর মতো ফল থেকে তৈরি হয় এই সবুজ জুস। যাঁরা নিয়মিত সবুজ শাকসবজি খান না, তাঁদের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ এই পানীয় খুবই উপকারী, জানাচ্ছেন ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান এবং মুম্বইয়ের ফর্টিস হাসপাতালের সার্টিফায়েড ডায়াবেটিস এডুকেটর সুমাইয়া এ। তিনি যোগ করলেন, “এটি হাইড্রেশন এবং ডিটক্সিফিকেশনে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে গ্রিন জুস শক্তিদায়কও।” তিনি আরও বললেন, এই ধরনের কম চিনির পানীয় ফলের রসের ভাল বিকল্প হতে পারে।
গ্রিন জুসের স্বাস্থ্য উপকারিতা গবেষণার দ্বারাও প্রমাণিত। উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রাযুক্ত পুরুষদের উপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, তিন মাস ধরে প্রতিদিন 150 মিলি কেলে শাকের রস পান করেছেন এমন মানুষজনের করোনারি ধমনী রোগের ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে।
গ্রিন জুস: গরমকালের অত্যন্ত সতেজ একটি পানীয়
চেন্নাইয়ের ডায়েটিশিয়ান ভুবনেশ্বরী বিদ্যাশঙ্কর, গ্রীষ্মকালে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সবুজ রসে কিছু উপাদান যোগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁর কথায়, “আপনি পুদিনা পাতা, দারুচিনি বা মেথি গুঁড়ো যোগ করতে পারেন, যা আপনার পেট ও শরীর উভয়ই ঠান্ডা করবে। এমনকি, ডাবের জল বা শসাও এই গরমের মরশুমে আপনার গ্রিন জুসের গ্লাসে দুর্দান্ত সংযোজন হতে পারে।”
তিনি এ-ও জানাচ্ছেন যে, এই ধরনের পানীয় তাজা রাখা বাঞ্ছনীয়, অর্থাৎ বানিয়েই খেয়ে ফেলতে হবে এবং তাজা উপাদান দিয়েই বানাতে হবে। তবে কেউ চাইলে আর একটু ঠান্ডা করে খেতে ফ্রিজেও এই পানীয় রাখতে পারেন বলে তিনি যোগ করলেন। তবে ফ্রিজে রাখার দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরে এই পানীয় খেয়ে ফেলাই ভাল বলে তিনি আরও জানালেন।
সুমাইয়া বললেন, “এখন যেহেতু গরমকাল চলছে, আপনি সপ্তাহে দু-তিনবার গ্রিন জুস খেতে পারেন। তার বেশি এক্কেবারেই নয়। তাছাড়াও আপনার গ্রিন জুসে প্রত্যেকবার বিভিন্ন ফল ও সবজির সংমিশ্রণ যোগ করার বিষয়টা নিশ্চিত করুন।”
গ্রিন জুস তৈরি করার সময় মাথায় রাখতে হবে
সুমাইয়া বলছেন, সবুজ জুস তৈরি করার ক্ষেত্রে সবসময় ফ্রেশ শাকসবজি বেছে নিতে হবে। তাঁর বক্তব্য, “তাদের সঠিকভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। আপনার জুসে যদি ফল যোগ করতে চান, তাহলে তা যেন নরম হয় তা নিশ্চিত করুন।”
তবে গ্রিন জুসে নির্দিষ্ট উপাদান যোগ করার সময় সতর্ক থাকতে হবে বলে জানালেন রোহাতগি। তাঁর কথায়, “কিছু শাকসবজির রস কাঁচা জুস হিসেবে খাওয়া উচিত নয়। ব্রকলি, বাঁধাকপি এবং ফুলকপির মতো ক্রুসিফেরাস সবজিতে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের হজম করা কঠিন করে তোলে। তাই, সেগুলিকে খাবার আগে কিছুক্ষণ ভাপানো দরকার।” তা যদি না করা যায়, তাহলে ফোলাভাব, গ্যাস, ক্র্যাম্পিং এবং ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS)-এর মতো গুরুতর সমস্যা হতে পারে। তার পাশাপাশি এই সত্যটিও মনে রাখা উচিত যে,শাক শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
ফলের কথা বলতে গিয়ে, রোহাতগি অ্যাভোকাডো এবং নারকেল যোগ করতে বারণ করছেন। কারণ তাদের রস কম থাকে। “আপেলও দ্রুত অক্সিডাইজ় হয় এবং তাই তার জুস করা উচিত নয়। তাদের বীজে অ্যামিগডালিন নামক একটি যৌগ থাকে, যা ভুলবশত রসে যোগ করলে বিষাক্ত হতে পারে। নাশপাতিতে প্রচুর পরিমাণে সরবিটল থাকে, এটি এক ধরনের অপাচ্য চিনি যা অনিয়মিত মলত্যাগের কারণ হতে পারে। তাছাড়া আনারস কাঁচা থাকাই ভাল। কারণ, এর রস রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে,” তিনি সতর্ক করে বলছেন।
ডায়েটিশিয়ান ভুবনেশ্বরী বিদ্যাশঙ্কর আবার বলছেন, কোথাও যদি গ্রিন জুস সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে প্লাস্টিকের পরিবর্তে তা কাচের বোতলে নিয়ে যেতে হবে। কারণ, প্লাস্টিকের রাসায়নিক পদার্থ পানীয়তে প্রবেশ করার সম্ভাবনা থেকে যায়।
গ্রিন জুস: কাদের জন্য আদর্শ নয়?
রোহাতগি বলছেন, যাঁদের কিডনির সমস্যা বা কিডনিতে পাথরের ইতিহাস রয়েছে, তাঁদের গ্রিন জুস খাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ, কেলে শাক এবং পালং শাকের মতো উপাদানে প্রচুর পরিমাণে অক্সালেট থাকে, যা তাদের কিডনির জন্য আরও ক্ষতিকারক হতে পারে। তাই, সংযম অত্যাবশ্যক বলে জানাচ্ছেন রোহাতগি।
“কেউ যদি পালং শাক দিয়ে গ্রিন জুস খেতে চান তাহলে অবশ্যই ব্লাঞ্চ করতে হবে। অর্থাৎ, সেটি ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে তারপর সঙ্গে সঙ্গে তা ঠান্ডা করা হবে,” সুমাইয়ার পরামর্শ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, যাঁদের দীর্ঘস্থায়ী কিডনির রোগ আছে, তাঁদের পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন বাতাবিলেবু, কমলালেবুর রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার কারণে অতিরিক্ত পটাসিয়াম নিষ্কাশন করতে অক্ষম হয়ে যান তাঁরা। এর ফলে তাদের শরীরে খনিজ জমতে থাকে এবং তার ফলে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়।
মোদ্দাকথা
* সবুজ শাকসবজি এবং ফল থেকে তৈরি সবুজ রস, ভিটামিন এবং খনিজের ভাল উৎস হতে পারে।
* এই জাতীয় পানীয়গুলিতে পুদিনা পাতা, ডাবের জল এবং দারুচিনির মতো কিছু উপাদান যোগ করলে গরমে শরীর ঠান্ডা রাখা যেতে পারে।
* একটি ব্যালান্সড্ ডায়েট হিসেবে গ্রিন জুস কখনই খাওয়া উচিত নয়। কারণ, এতে সমস্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি থাকে না।
* গ্রিন জুস খেয়ে ভাল ফলাফল পেতে টাটকা-তাজা উপাদান বেছে নিতে হবে। এছাড়াও, গ্রিন জুসের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট ফল ও সবজি এড়িয়ে চলা গুরুত্বপূর্ণ।