প্রশ্ন উঠেছিল আগেই। আর এই প্রথমবার কোভিড অতিমারির টিকা কোভিশিল্ড প্রস্তুতকারক সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনেকা স্বীকার করল যে, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। এই টিকা নিয়েছেন এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিন্ড্রোম বা TTS ডেভেলপ করতে পারে। যদিও তা বিরল থেকে বিরলতম ক্ষেত্রেই দেখা দিতে পারে বলে অ্যাস্ট্রাজেনেকার তরফে জানানো হয়েছে।
থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিন্ড্রোমে রক্তের জমাট বাঁধা (থ্রম্বোসিস গঠন) এবং কম প্লেটলেট গণনার (থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া) মতো একাধিক গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়। এই রক্ত জমাটগুলি অস্বাভাবিক জায়গায় তৈরি হতে পারে এবং তার ফলে শরীরের নির্দিষ্ট অংশে রক্ত প্রবাহের ক্ষতি হতে পারে। রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্লেটলেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, যখন তাদের সংখ্যা কমে যায়, তখন রক্তপাত বন্ধ করা কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের ক্ষেত্রে তা বিপজ্জনকও হয়ে উঠতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে হইচই পড়ে যায়, যখন ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফে একটি আইনি নথিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকা উল্লেখ করেছিল যে, টিকা দেওয়ার পরে TTS-এর মতো বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এখন এই বিষয় নিয়ে কোটি কোটি ভারতীয়ের মধ্যে তীব্র উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, দেশের একটা বড় অংশের মানুষ কোভিড অতিমারির সময় এই টিকা নিয়েছিলেন।
ভারতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার 174 কোটি কোভিশিল্ড ডোজ়
আপনাদের হয়তো মনে থাকবে, 2021 সালের জানুয়ারি মাসে এ দেশে COVID-19 টিকা দেওয়া শুরু হয়েছিল। সে সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের এই টিকার অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রবীণ নাগরিকদের, কোমর্বিটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের এবং ধীরে ধীরে সমস্ত সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদেরই এই টিকা দেওয়া হয়েছিল। কোউইন ডেটা থেকে জানা গিয়েছে, ভারতে কোভিড টিকার মোট 220 কোটি ডোজ় ব্যবহার করা হয়েছিল। তার মধ্যে 174 কোটি ডোজ বা 79% ছিল কোভিশিল্ড, যা 2024 সালের 30 এপ্রিল পর্যন্ত পরিসংখ্যান। এছাড়া দেশে কোভ্যাকসিনের 36.3 কোটি ডোজ় এবং কোর্বেভ্যাক্সের 7.3 কোটি ডোজ় ব্যবহার করা হয়েছিল। ডেটা থেকে আরও জানা গিয়েছে যে, ভারতে কোভিজ অতিমারি চলাকালীন টিকাদানের পরে প্রায় 0.007% বিরূপ প্রভাব দেখা গিয়েছিল।
এই মুহূর্তে যেখানে কোভিশিল্ড নিয়ে দেশবাসীর মনে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, সেখানে নেটিজ়েনদের একটা বড় অংশ এই ভ্যাকসিনকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই না করার জন্য সরকারের দিকে সরাসরি আঙুল তুলেছেন। যদিও অনেক ভারতীয় ডাক্তারই বলেছেন যে, এই টিকা কোভিড অতিমারির ভয়াবহ রূপ প্রতিরোধে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং মৃত্যুর হার কমাতে বড় ভূমিকা পালন করেছে।
কোভিশিল্ডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: চিন্তার কি কোনও কারণ আছে?
কমিউনিটি বিশেষজ্ঞ এবং কর্নাটকে কোভিডের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজ়ারি কমিটির প্রাক্তন চেয়ারপার্সন ডাঃ এম কে সুদর্শন হ্যাপিয়েস্ট হেলথের কাছে জানিয়েছেন, এই ভ্যাকসিনটি সংক্রমণের ভয়াবহতা রোধে এবং অতিমারির অগ্রগতি রুখে দিতে মূল অস্ত্র হয়ে কাজ করেছে। তাঁর কথায়, “যখন আপনি টিকার ফলাফল বিচার করতে বসবেন, তখন দেখবেন তার ঝুঁকির চেয়ে সুবিধা অনেক বেশি। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা যে জরুরি অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম, সেখানে তো বটেই।”
ডাঃ সুদর্শন বলছেন, কোভিশিল্ডের মতো ভ্যাকসিনেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে বাধ্য, যা হাল্কা, মাঝারি বা কারও ক্ষেত্রে গুরুতরও হতে পারে। “কোভিড টিকা ছিল একটি বিশেষ ওষুধ, যা দ্রুততার সঙ্গে প্রস্তুত করতে হয়েছিল এবং বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার জন্য ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, এত কম সময়ের মধ্যে, এটি নিয়মিত ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না। তা যদি হত, তাহলে ওষুধের আবিষ্কার থেকে প্রশাসন এবং সর্বোপরি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে 5 থেকে 10 বছর সময় লেগে যেত”, ব্যাখ্যা করে বললেন তিনি।
ব্যাঙ্গালোরের সেন্ট জন্স ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ফিজিওলজির অধ্যাপক ডাঃ আনুরা কুরপাদ একমত হয়েছেন যে, সাধারণভাবে সমস্ত ভ্যাকসিন বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। “আপনি মানবদেহে দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় ব্যাকটেরিয়া পরিচালনা করার ক্ষেত্রে এটা আশা করতে পারেন না যে প্রত্যেকে, তার সুফল পাবেন। কিছু লোক অপ্রত্যাশিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে বাধ্য,” বললেন ডাঃ কুরপাদ।
ডাঃ সুদর্শন জানাচ্ছেন, অতিমারি পরিচালনা করতে যে কারণগুলি বেশি সহায়ক হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ফেস মাস্কের ব্যবহার, লকডাউন, রাতের কারফিউ, সপ্তাহান্তে কারফিউ এবং এলাকা সিল-ডাউনের মতো একাধিক বিধিনিষেধ। সেই সঙ্গেই আবার ভ্যাকসিনেরও একটি প্রধান ভূমিকা ছিল। তিনি যোগ করেছেন, কোনও টিকাকরণ প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ের তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাবে। তাই, সময়সীমার মধ্যে যদি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা না যায়, তাহলে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন এবং তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তা করার কোনও দরকার নেই।
কোভিশিল্ডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রথম তুলে ধরে WHO
কেরালার কোচির গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট এবং ন্যাশনাল আইএমএ কোভিড টাস্ক ফোর্সের সহ-চেয়ারম্যান ডাঃ রাজীব জয়দেবন বলছেন, TTS-এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এটিকে অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিনগুলির একটি অত্যন্ত বিরল অস্বাভাবিক ইমিউন প্রতিক্রিয়ার সঙ্গেও যুক্ত করা হয়েছে। তাঁর কথায়, “2021 সালের মে মাসের প্রথম দিকে কোভিশিল্ড নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল WHO।” ডাঃ জয়দেবন জানাচ্ছেন, টিকার পরে TTS একটি অত্যন্ত বিরল ঘটনা, যা শুধুমাত্র টিকাকরণের প্রথম মাসেই ঘটে। “এই অবস্থার প্রায় 30% সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে যায়। তবে, কিছু কিছু মানুষের গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা মারাত্মকও প্রমাণিত হতে পারে,” তিনি বললেন।
ডাঃ জয়দেবন যোগ করেছেন যে, ভারতে ব্যবহৃত COVID-19 ভ্যাকসিনগুলির সুরক্ষা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর আরও বক্তব্য, “বেশিরভাগ লোকেরই কোনও উল্লেখযোগ্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছিল না। কিছু মানুষের জ্বর, ক্লান্তি, এবং ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য যথাস্থানে এক বা দুই দিনের জন্য ব্যথা ছিল। আর সেটা খুবই সাধারণ, হতেই পারে। যাইহোক, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এই ধরনের বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুধুমাত্র খুব বেশি সংখ্যক লোককে টিকা দেওয়ার পরেই দেখা যায়।”
ডাঃ সুদর্শনের সঙ্গে সহমত পোষণ করে ডাঃ জয়দেবন বলছিলেন যে, ভারতে কোটি কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছিল এবং তা উপকারী বলেই মনে হয়েছে। তাঁর কথায়, “মার্কিন ভিত্তিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অতিমারি চলাকালীন সময়ে 232,000 থেকে 318,000 মানুষ মারা গিয়েছিল। কারণ তারা COVID-19 ভ্যাকসিন নিতে অস্বীকার করেছিল। এটি সিস্টেমের প্রতি অতিরিক্ত ভয় এবং অবিশ্বাসের কারণে হয়েছিল। ভারতের মানুষজন যদি ভ্যাকসিন না নিত, তাহলে আমাদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি হত।” ডাঃ কুরপাদ যোগ করেছেন, “কোভিড টিকাদানের ইতিহাস এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করার সময় বিবেচনা করা দরকার। কার্যকর ওষুধের অভাবে ভ্যাকসিনই ছিল একমাত্র আশার আলো।”
মোদ্দাকথা
2021 সাল থেকে দেশে প্রায় 174 কোটিরও বেশি কোভিশিল্ড ডোজ় দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি কোভিশিল্ডের সৃষ্টিকর্তা অ্যাস্ট্রাজেনেকা স্বীকার করে নিয়েছে যে, কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিন্ড্রোম বা TTS নামক বিরল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এটি রক্ত জমাট বাঁধার একটি বিরল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। তবে ডাক্তাররা বলছেন, এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও কোভিশিল্ড মৃত্যু প্রতিরোধে এবং গুরুতর সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে অত্যন্ত কার্যকর ছিল।