বয়স তাঁর 48। আর এই বয়সে আসার আগে তাঁকে যেতে হয়েছে একাধিক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে, মুখোমুখি হতে হয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জের। তিন-তিন বার গর্ভপাত করতে হয়েছে, যার প্রত্যেকটিই একপ্রকার জোরজবরদস্তি ছিল। তার মধ্যে একটিতে চিকিৎসার যথেষ্ট অবহেলার ফলে HIVতে আক্রান্ত পর্যন্ত হতে হয়। সেই জ্যোতি ধাওয়ালে আজ ‘দ্য ওয়েল’ প্রজেক্টের গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর। ‘দ্য ওয়েল’ হল একটি অলাভজনক সংস্থা, যেটি এইচআইভি আক্রান্ত নারীদের পাশে দাঁড়ায়। HIV নিয়ে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখে যাতে এইচআইভি/এইডস নিয়ে খুল্লমখুল্লা কথা বলতে পারেন, সেই দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন জ্যোতি। কথা বলতে শুরু করেছিলেন নিজেও, অন্যদেরও কথা বলতে সাহায্য করেছিলেন।
কী ভাবে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করা যায়, সে সম্পর্কে ডাক্তার, কর্পোরেট কর্মচারী এবং অন্যান্য বিভিন্ন সংস্থাকে শিক্ষিত করার কাজ করেন জ্যোতি ধাওয়ালে। এইচআইভি নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার জন্য নানাবিধ সেশনের আয়োজন করেন তিনি। সেই সঙ্গে HIV নিয়ে সমাজে কলঙ্ক ও বৈষম্য দূর করার বিষয়ে ডাক্তারদেরও প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর কথায়, “কী ভাবে একসঙ্গে বসবাস করতে হয় তা মানুষকে শিখতে হবে এবং সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে একজন এইচআইভি রোগীকে গ্রহণও করতে হবে।”
সব প্রতিকূলতার মোকাবিলা
মাত্র তিন বছর বয়সে জ্যোতির বাইল্যাটেরাল সেনসোনিউরাল হিয়ারিং লস বা দ্বিপাক্ষিক সংবেদনশীল শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। এটি এমনই একটি জটিল সমস্যা, যেখানে জ্যোতির কানে খুবই উচ্চস্বর পৌঁছত। তবে পরবর্তী কথোপকথন বোঝার জন্য বক্তার ঠোঁট অনুসরণ করতে হত। শুধু তাই নয়। স্পিচ ডিফেক্টও রয়েছে তাঁর অর্থাৎ কিছু কথা বুঝতে যথেষ্টই অসুবিধা হয় জ্যোতি ধাওয়ালের। কিছু বর্ণমালা যেমন ইংরেজির ‘সি’ (C) অক্ষর উচ্চারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে যায়।
শৈশব থেকে কথা বলার সমস্যা ছিল। ছিল শ্রবণশক্তির সমস্যাও। কিন্তু জ্যোতি যখন বিয়ের পিঁড়িতে বসছিলেন, সব দুঃখ ভুলে বেশ খুশিই ছিলেন। কিন্তু সমস্যা সেখানেও। একাধিক বার তাঁকে গর্ভপাত করানো হয়। পরবর্তীতে 2005 সালে চতুর্থ সন্তান আসায় যখন তিনি গর্ভবতী হন, তখন HIV-পজ়িটিভ ধরা পড়ে। গর্ভপাতের সময় চিকিৎসার অবহেলার কারণে সংক্রমণ হয়েছিল বলে জানালেন জ্যোতি ধাওয়ালে। তারপরে আবার তিনি বৈবাহিক যৌন নির্যাতনেরও শিকার হন। তাঁর সন্তানের বয়স যখন মাত্র ছয় মাস, তখন জ্যোতি এবং তাঁর স্বামী আলাদা হয়ে যান। মানসিক অবসাদের কথা মনে করে তিনি বললেন, “আমি যত বেশি চাপ এবং হতাশা অনুভব করছিলাম, এইচআইভি পজ়িটিভ হওয়ার কলঙ্ক আমার কাছে আরও পীড়াদায়ক হয়ে উঠছিল।”
এত কিছুর পরেও সুস্থ এবং ফিট থাকা
জ্যোতি ধাওয়ালে তাঁর জীবনে একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকি, এখনও সেই সব স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন, যা দিনের দিন তাঁকে ব্যাপক ক্লান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এত কিছু সত্ত্বেও তিনি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জ্যোতি বলছেন, শরীর ভাল রাখা অত্যাবশ্যক। তাই, তিনি পর্যাপ্ত ঘুমান এবং মানসিক চাপ পরিচালনা করার জন্য মননশীলতার অনুশীলন নিশ্চিত করেন। অস্বাস্থ্যকর খাবার এক্কেবারেই এড়িয়ে চলেন এবং নিয়মিত ওজনও ট্র্যাক রাখেন। তিনি জাঙ্ক ফুড এবং চর্বিযুক্ত খাবার খান না। তার পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্য বেছে নেন। তার পাশাপাশিই আবার তিনি স্ক্রিন টাইমও সীমিত রাখেন। হাতে কিছু কাজ না থাকলে ফোনটাকে দূরে সরিয়ে রাখেন। ধাওয়ালে প্রতি ছয় মাসে নিয়মিত ভাবে সারা শরীরটারই পরীক্ষা করেন এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছেও যান।
সচেতনতা জরুরি
নিয়মিত ভাবে এইচআইভি/এইডস সম্পর্কে পরীক্ষা করা এবং তা জানানো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি যৌনসঙ্গম, ইঞ্জেকশনের সূচ ব্যবহার, রক্ত সঞ্চালন, শারীরিক তরল বিনিময় এবং মা থেকে সন্তানের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে। অনেক সময় HIV-এর উপসর্গ না-ও থাকতে পারে, যেমনটা জ্যোতির ক্ষেত্রে হয়েছিল।
জ্যোতি ধাওয়ালে এইচআইভি-পজ়িটিভ ছিলেন এবং বিশ্বজুড়ে এই একই অবস্থার সঙ্গে বসবাসকারী মানুষজনের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করতে তাঁর দীর্ঘ চার বছর সময় লেগেছিল। পাবলিক ফোরামে তিনি সক্রিয় ভাবে এই পরিস্থিতির সঙ্গে বসবাসের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন এবং প্রতিদিন সচেতনতা তৈরি করেন। তিনি বলছিলেন যে, এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদের কলঙ্ক এবং বৈষম্য কাটিয়ে উঠতে সমাজকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। মনে রাখতে হবে HIV/এইডস কাশি, কাউকে স্পর্শ করা বা এমনকি এক গ্লাসে জল ভাগাভাগি করে খেলেও ছড়াতে পারে না।
নিজের বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে যে লড়াই জ্যোতি শুরু করেছিলেন, তা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গেই আবার তাঁর মতো একই সমস্যার সম্মুখীন যাঁরা, তাঁদেরও পাশে দাঁড়ানোর কাজ করে চলেছেন তিনি। পাল্লা দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন এইচআইভি সম্পর্কে সমাজ সচেতনতার কাজও। বললেন, “যতবার আমি হোঁচট খাই, পড়ে যাই”
ধওয়ালে এখনও মাঝে মাঝে স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির সাথে লড়াই করে তবে সর্বদা একটি সময়-পরীক্ষিত পদ্ধতিতে ফিরে আসে। “যতবার আমি হোঁচট খাই এবং পড়ে যাই, ততবারই পিছনে না ফিরে আবারও চলতে থাকি।”