সেই দিন তিনি অফিসে কাজ করছিলেন। 52 বছর বয়সী কেরালার কৃষ্ণকুমার কে পেশায় একজন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। ঘটনাটা 2021 সালের। শরীরের বামদিকটা জুড়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভব করছিলেন এবং তীব্র মাথা ব্যথায় একপ্রকার কাতরাচ্ছিলেন। হুট করেই তাঁর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায় এবং হাতের সামনে যে কাগজটা ছিল, তাতে কী লেখা ছিল সেটাই পড়তে পারছিলেন না।
“আমি কি দৃষ্টি হারিয়ে ফেলছি?” ক্ষণিকের জন্য এমনই চিন্তাভাবনা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি ঘাবড়ে যান এবং লক্ষ্য করেন, বাঁ হাতটা নাড়াতে পারছেন না। বিশৃঙ্খলা যেন তাঁকে গ্রাস করছিল। সে সময় পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছিল বলে জানালেন তিনি। বললেন, “তখন আমি চেয়ার থেকে ওঠার চেষ্টা করলাম আর সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম।”
সহকর্মীরা তড়িঘড়ি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে যাওয়া মাত্রই ডাক্তাররা চেকআপ করেন এবং জানান, হাই ব্লাড প্রেসারের কারণে কৃষ্ণকুমারের স্ট্রোক হয়েছে। ডাক্তাররা আরও জানান যে, তাঁর বাম দিকটা প্যারালাইজ হয়ে গিয়েছে।
যখন স্ট্রোক হয়
“স্ট্রোক হল একটি নিউরোভাসকুলার অবস্থা যার জন্য জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন,” বলছেন ডাঃ সোমেশ ভাঞ্চিলিঙ্গম, সিনিয়র কনসালট্যান্ট নিউরো বিশেষজ্ঞ এবং চেন্নাইয়ের ডাঃ ভ্যানচিলিংম হাসপাতালের স্ট্রোক ডাক্তার। হঠাৎ রক্তপ্রবাহে বাধা বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে স্ট্রোক হয়। এটি মস্তিষ্ক বা শরীরের অন্যান্য বেশ কিছু অঞ্চলে অক্সিজেন সরবরাহ এবং পুষ্টি বন্ধ করে দেয়। ফলে, নিউরন বা মস্তিষ্কের কোষ মরতে শুরু করে।
যেহেতু শরীরের বাকি অংশের তুলনায় মস্তিষ্কের অক্সিজেন এবং পুষ্টির বেশি প্রয়োজন হয়, তাই স্ট্রোক হলে তার বাধা দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবন্ধকতার দিকে পরিচালিত করে। পেশি দুর্বলতা, পক্ষাঘাত, কথা বলতে অসুবিধা, ধীরগতিতে চলাফেরা বা চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা, দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি দুর্বল হওয়ার মতো একাধিক গুরুতর সমস্যা স্ট্রোকের লক্ষণ।
আয়ুর্বেদের মাধ্যমে স্ট্রোক থেকে বেঁচে ফেরা
“আয়ুর্বেদে স্ট্রোককে পক্ষঘাত হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং এটিকে বাতের অধীনেই ধরা হয়,” বলছেন বেঙ্গালুরুর শ্রীতুলসী আয়ুর্বেদালয় প্রধান আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ডাঃ শ্রীহর্ষ কে ভি। তিনি জানালেন, বায়ু এবং স্থান এই দুই উপাদানের ভারসাম্যহীনতার ফলে এই অবস্থা দেখা দেয়। শরীরের নড়াচড়া এবং সঞ্চালনের জন্য দায়ী হল বায়ু। ফলে, স্ট্রোক হলে ব্যক্তির চলাচলে অসুবিধা, দুর্বল সঞ্চালন, দুর্বল অনাক্রম্যতা এবং স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যাগুলির সম্মুখীন হন।
স্ট্রোকের কিছু প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, হঠাৎ পেশির দুর্বলতা, চোখে ঝাপসা দেখা, অসংলগ্নতা এবং কথোপকথনে অক্ষমতা।
স্ট্রোক পরবর্তী লক্ষণগুলি পরিচালনা করা
ডাঃ ভাঞ্চিলিঙ্গম বলছেন, “আইসিইউ এবং ক্যাথেটারাইজেশন ল্যাব রয়েছে, এমন হাসপাতালেই স্ট্রোকের চিকিৎসা করা উচিত।” তিনি আরও যোগ করে বলছেন, “পুনর্বাসন পর্যায়ে ফিজিওথেরাপি এবং প্যাসিভ যোগব্যায়ামের মতো থেরাপি অনেকটাই উপকারী হবে।”
স্ট্রোক ব্যাপক ভাবে শরীরের পেশি শক্তি এবং রক্ত সঞ্চালন প্রভাবিত করে। ডাঃ শ্রীহর্ষ কিছু আয়ুর্বেদ পদ্ধতির তালিকা দিয়েছেন যা স্ট্রোক পরবর্তী শুশ্রুষার জন্য ব্যক্তিকে স্বস্তি দিতে পারে: ভেষজ তেল মালিশ (অভয়ঙ্গ), চালের বলাস চিকিৎসা (শাস্তিক শালি), মলম (লেপা) এবং মেডিকেটেড এনিমা (বস্তি) দিয়ে শরীরকে পুষ্ট করা। এই প্রতিকারগুলি আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরের শক্তি ফিরে পেতে এবং স্ট্রোকের জটিলতা কমাতে সাহায্য করে।
অশ্বসন (আক্ষরিক অর্থে যা ‘আশ্বাস’ বা ‘মনোবল বুস্টার’) বা সাইকোথেরাপি সংশ্লিষ্ট উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার জন্য সুপারিশ করা হয়।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কৃষ্ণকুমারকে 21 দিনের জন্য রিহ্যাবিলিটেশন কেয়ারে দেওয়া হয়। স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত তিনি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করছেন। পুনরায় যাতে এমন ঘটনা তাঁর সঙ্গে আর না ঘটে, তাই জীবনধারাতেও একাধিক পরিবর্তন করেছেন। এখন কৃষ্ণকুমার ভাজাভুজি খাবার এক্কেবারেই এড়িয়ে যান এবং বেশি করে শাক ও সবজি খান।
ডাঃ ভাঞ্চিলিঙ্গম ব্যাখ্যা করলেন, মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি এবং ইন্ট্রাভেনাস বা IV থ্রম্বোলাইসিস হল রক্তের সরবরাহ পুনরুদ্ধার করার জন্য সাম্প্রতিকতম শ্রেষ্ঠ মানের চিকিৎসা। তিনি আরও গুরুত্ব দিয়ে বলছেন, এই থেরাপিগুলি পরিচালনা করার জন্য সঠিক সময়টা বেছে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়মত রিভাসকুলারাইজেশন থেরাপি স্ট্রোকের লক্ষণগুলিকে কমিয়ে দিতে পারে এবং স্ট্রোক পরবর্তী সমস্যা ও মৃত্যু থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে।
জীবনটা নতুন করে শুরু করা
ফিজ়িওথেরাপি ও তার সঙ্গে হেলদি ডায়েট স্ট্রোক পরবর্তী সময়ে মানুষকে প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করে, বলছেন ডাঃ স্টিফেন আব্রাহাম, ফিজিওথেরাপিস্ট, ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি ফর হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স, বেঙ্গালুরু।
তাঁর ব্যাখ্যা, “স্ট্রোকের পরে ফিজ়িওথেরাপি সাধারণত মাসলের জড়তা, স্প্যাস্টিসিটি এবং শরীরের ভারসাম্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য করা হয়।” “একজন ব্যক্তি যদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করতে না পারেন, তাহলে আমরা প্যাসিভ মুভমেন্ট করি, যাতে পেশির দৃঢ়তা এড়ানো যায়। ফলে পেশি আরও উদ্দীপিত এবং শক্তিশালী হয়। সেই সঙ্গে মানুষ প্রাত্যহিক কাজকর্মও শুরু করতে পারেন,” যোগ করলেন ডাঃ আব্রাহাম।
রিহ্যাবিলিটেশন ম্যানেজমেন্ট বা পুনর্বাসন ব্যবস্থাপনা স্ট্রোকের প্রভাব অনুসারে কাস্টমাইজ করা হয়েছে। এটি ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস, বিকৃতি এবং ব্যথা ব্যবস্থাপনায় রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে।
কৃষ্ণকুমার বললেন, “এখন আমি 70 শতাংশ কাজকর্ম আমার বাঁ-হাতের সাহায্যেই করি।” দৈনন্দিন রুটিনেও তিনি একাধিক পরিবর্তন করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে সপ্তাহে দু’বার ফিজ়িওথেরাপি এবং প্রতিদিনের ব্যায়াম এবং আধ ঘণ্টার জন্য প্রাণায়ম। পাশাপাশি তিনি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ভেষজ ওষুধও খান।
তাঁর কথায়, “স্নান করার মিনিট দশেক আগে তেলে ভেজানো ছোট্ট একটা কাপড় মাথায় দিয়ে রাখি।” “মাশরুম, জাফরান এবং অ্যালোভেরা সহযোগে একটি সুষম, কম সোডিয়ামের ডায়েট অনুসরণ করি,” যোগ করলেন তিনি। কৃষ্ণকুমার জানালেন, প্রতিদিন তিনি কমপক্ষে 2.5 লিটার গরম জল খেয়ে নিজেকে হাইড্রেটেড রাখেন।
প্রতিরোধ এবং যথাসময়ে যত্ন
ডাঃ ভাঞ্চিলিঙ্গম বলছেন, “প্রতিরোধ সবসময় রোগের চিকিৎসার থেকে ভাল। স্বাস্থ্যকর ডায়েটস ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, ধূমপান ও অ্যালকোহল বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় এবং স্বাস্থ্যকর ও সুখী জীবনের দিকে পরিচালিত করে।”
ডাঃ শ্রীহর্ষ যোগ করেছেন, যোগব্যায়ামের অনুশীলন এবং একটি প্রজ্বলিত মোমবাতির দিকে তাকানো (ত্রতাকা) পুনর্বাসনে সাহায্য করতে পারে।
উভয় ডাক্তারই একটি বিষয়ে জোর দেন যে, স্ট্রোকের কারণে ক্ষতির পরিমাণ কমাতে প্রাথমিক রোগ নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও জরুরি হল, স্ট্রোকের লক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা এবং ব্যক্তিকে নিকটতম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, যেখানে স্ট্রোক থ্রম্বেক্টমির সুবিধা মিলতে পারে।