‘পেট ব্যথা করছে’, বাচ্চাদের মুখ থেকে প্রায়শই আমরা এই কথা শুনতে পাই। সাধারণত, ছোটরা তাদের ব্যথা সম্পর্কে বিশদে বলতে পারে না। কারণ, পেট ব্যথার লক্ষণগুলি বর্ণনা করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। ফলে, বাচ্চার মা-বাবার পক্ষেও বিষয়টা বিভ্রান্তিকর হয়ে যায় যে তাঁদের সন্তান দু-একদিন স্কুল না যেতে অজুহাত দিচ্ছে কি না। তবে বাচ্চার পেট ব্যথা সম্পর্কে অভিভাবকদের আরও সিরিয়াস হতে হবে। কিছু পেট ব্যথা এমন হয়, যা একবারে নিস্তেজ এবং সাধারণ পেট ব্য়থার থেকে অনেকটাই আলাদা। এই ধরনের পেট ব্যথাকে ‘অ্যাবডমিনাল মাইগ্রেন’ বা পেটের মাইগ্রেন বলা হয়।
পেট ব্যথা এবং পেটের মাইগ্রেনের মধ্যে পার্থক্য
মূলত খাবার খাওয়া বা বদহজমের কারণে প্রায়শই পেটে ব্যথা হয়। এই ধরনের সাধারণ পেট ব্যথা খুব একটা বেশি সময়ের জন্য স্থায়ী হয় না এবং তা ক্ষণে-ক্ষণে প্রায়শই দেখা দিতে পারে।
“পেটের মাইগ্রেনের ক্ষেত্রে ব্যথার জন্য কোনও উত্তেজক কারণ না-ও থাকতে পারে। হঠাৎ করেই পেট ব্যথা করতে পারে এবং তা এক ঘণ্টা থেকে তিন দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে,” বলছেন ব্যাঙ্গালোরের ফর্টিস হাসপাতালের জিআই অ্যান্ড ব্যারিয়াট্রিক সার্জারির প্রধান ডাঃ গণেশ শেনয়।
মুম্বইয়ের ফর্টিস হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির পরিচালক ডাঃ ভিপুলরয় রাঠোড় যোগ করে বলছেন, “এই ব্যথা কখনও নিস্তেজ হতে পারে, কখনও আবার এই ব্যথা খুব যন্ত্রণাদায়কও হতে পারে।” এছাড়াও পেটের মাইগ্রেনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হল বমি বমি ভাব।
ডাঃ শেনয় বলছেন, “পেটের মাইগ্রেন আবার অনেক সময় মাথাব্যথার সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। কারণ, পেটের মাইগ্রেনে আক্রান্তদের অন্তত 25 শতাংশের জীবনে কখনও না কখনও মাইগ্রেন থেকে মাথাব্যথা হবে।”
পেটের মাইগ্রেন কীভাবে হয়?
অজ্ঞাত কারণে পেটের ব্যথা সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। আবার পুরুষদের তুলনায় মহিলাদেরই বেশি করে পেটের মাইগ্রেন হয়।
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতে তিন দশকেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে ডাঃ রাঠোড়ের। তিনি বলছেন, “বাচ্চাদের মধ্যে পেটের মাইগ্রেনের সবচেয়ে সাধারণ কারণটি জেনেটিক হতে পারে। এছাড়াও অন্ত্রের সংক্রমণ থেকে শুরু করে খাবারে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ার মতোও বেশ কিছু অন্যান্য কারণে পেটের মাইগ্রেন দেখা হতে পারে।”
তিনি আরও যোগ করে বলছেন, “মহিলাদের মধ্যে হরমোনের পরিবর্তন এবং চক্রীয় পরিবর্তনগুলি অন্ত্রের গতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। সেখানে কঠিন খিঁচুনির সৃষ্টি করে পেটের মাইগ্রেনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।” তবে প্রাপ্তবয়স্কদেরও পেটের মাইগ্রেন হতে পারে। যদিও তা বাচ্চাদের মতো ঘনঘন নয়।
পেটের মাইগ্রেনের অন্যান্য কারণ
নির্দিষ্ট কিছু খাবার, পরিবেশগত কারণ, জেনেটিক, এমনকি প্রচণ্ড মানসিক চাপ থেকেও পেটের মাইগ্রেন হতে পারে। তবে ঠিক কোন কারণে তা হচ্ছে যথাসময়ে সনাক্ত করা গেলেই প্রতিরোধের কাজটা সহজ হয়ে যায়।
ডাঃ রাঠোড় বলছেন, “একাধিক কারণে একজনের পেটে মাইগ্রেন হতে পারে। দীর্ঘ দিন ধরে ভাল ঘুম না হওয়া, ক্রমাগত মাথাব্যথা, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সংক্রমণের আকারে হজমের সমস্যা এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ট্রমা থাকলে একজন পেটের মাইগ্রেন অনুভব করতে পারেন।”
কিছু মানুষের মধ্যে আবার চকোলেট, কফি, সাইট্রাস ফল-সহ অন্যান্য খাবারে অ্যালার্জি প্রবণতা থাকলে তা থেকেও পেটের মাইগ্রেন হতে পারে। “ভিটামিন B12 এবং ভিটামিন D3 মাত্রা কমে গেলেও পেটের মাইগ্রেন হতে পারে,” যোগ করলেন ডাঃ রাঠোড়।
ডাঃ শেনয় বলছেন, “কী কারণে পেটের মাইগ্রেন হচ্ছে, তার ট্রিগারিং কারণগুলি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে। কখনও কারও ক্ষেত্রে বাইরের খাবারের কৃত্রিম স্বাদ হতে পারে এর কারণ। কিছু মানুষের জন্য আবার উচ্চ তীব্রতার আলোও এর কারণ হতে পারে।”
শুধু তাই নয়। স্ট্রেসের কারণেও পেটের মাইগ্রেন হতে পারে। ডাঃ রাঠোড় বললেন, “গাট-ব্রেইন অ্যাক্সিস বা অন্ত্র-মস্তিষ্কের অক্ষ হল এমনই একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে অন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করে। সেখান থেকেই মানসিক স্বাস্থ্য অন্ত্রের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে এবং তার ঠিক উল্টোটাও হতে পারে।”
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
পেটের মাইগ্রেনের ধরাটা জরুরি অর্থাৎ প্রাথমিক ভাবে রোগ নির্ণয় করাটা দরকার। কারণ, অনেকেই একে সাধারণ পেট ব্যথার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে পারেন।
ডাঃ রাঠোড়ের কথায়, “রোগ নির্ণয় করতে গেলে প্রাথমিক কিছু রক্ত পরীক্ষা, ভিটামিন বি 12 এবং ভিটামিন ডি 3-এর স্তর পরীক্ষার মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।” রোগ নির্ণয়ের প্রাথমিক কয়েক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণগুলির উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা নির্ধারিত হয়।
“উদাহরণস্বরূপ, যদি এটি স্ট্রেস থেকে হয় তাহলে কাউন্সেলিং এবং সাইকোথেরাপি প্রয়োজন। বারংবার ঘুম বিঘ্নিত হওয়া থেকে যদি পেটের মাইগ্রেন হয় তাহলে তা মানসম্পন্ন ঘুমও পেতে সাহায্য করে,” বলছেন ডাঃ শেনয়। তাঁর আরও বক্তব্য, “অনেকের ক্ষেত্রে আবার চোখ থেকে পেটের মাইগ্রেন হয়। সে ক্ষেত্রে তাঁদের ফ্ল্যাশ লাইট এড়িয়ে চলা উচিত। আবার খাবারের কারণেও যেহেতু এই ধরনের ব্যথা হতে থাকে, তাই খাবারের সঠিক ডায়েট চার্ট অনুসরণ করা উচিত এবং এমন কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত, যা থেকে পেটের মাইগ্রেন হতে পারে।”
“দুই সপ্তাহের পরেও যদি ব্যক্তির মধ্যে পেটের মাইগ্রেনের আগের উপসর্গগুলি থাকে, তাহলে এন্ডোস্কোপির পরামর্শ দেওয়া হয়,” বললেন ডাঃ রাঠোড়।
মোদ্দাকথা
* পেটের মাইগ্রেন হল এমনই একটি নিস্তেজ বা যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা, যার একাধিক কারণ রয়েছে।
* ক্যাফেইন, সাইট্রাসের মতো ফল থেকে পেটের মাইগ্রেন হতে পারে। জেনেটিক, ব্যাকটেরিয়াল অন্ত্রের সংক্রমণ এবং মানসিক অবস্থাও পেটের মাইগ্রেনের জন্য দায়ী হতে পারে।
* যেহেতু উপসর্গের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করা হয়, তাই খিঁচুনি বা ব্যথার অন্য কোনও সম্ভাব্য কারণ খুঁজে বের করতে রোগ নির্ণয় অত্যন্ত জরুরি।