একদিন সকালে বেঙ্গালুরু নিবাসী চিত্রা, ৫৮, (অনুরোধে পদবী গোপন রাখা হয়েছে) নিজের গালে হালকা বাদামী রঙের একটি দাগ দেখতে পেলেন। তার মনে হল, হয়তো রান্না করতে গিয়ে অজান্তে গাল পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু তাও এই দাগ নিয়ে অফিসে গিয়ে সহকর্মীদের মুখোমুখি হওয়ার কথা ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন বোধ করছিলেন।
“হঠাৎ করে, কোনো কারণ ছাড়াই আমার ডান গালে একটা ডিম্বাকৃত দাগ দেখা দিল,” চিত্রা জানালেন, “যা দেখে আমি চমকে উঠি এবং দাগটা ঢাকার জন্য কন্সিলার (concealer) ব্যবহার করি। প্রথমে মনে হয়েছিল যে হয়তো রান্না করতে গিয়ে গরম তেল ছিটকে এসে গালে পড়েছে। তাই খানিকটা পোড়া-নিরোধক মলম–ও ব্যবহার করেছিলাম।”
কিন্তু চিত্রা আসল স্বস্তি কিছুদিন পর পেয়েছিলেন। “দাগের রংটা আরও গাঢ় হয়ে যাচ্ছে দেখে আমি একজন ত্বক বিশেষজ্ঞের কাছে যাই। তিনি আমায় জানান যে এই দাগটা বয়সের কারণে দেখা দেওয়া আঁচিল এবং ত্বকের ক্যানসারের জন্য এটি নয়, তাই ভয়ের কোনও কারণ নেই,” চিত্রা বললেন।
সেবোরিক কেরাটোসিস কী?
ত্বকের দৃশ্যমান জায়গাগুলিতে, বিশেষ করে বয়স্কদের ত্বকে বাদামী অথবা কালো ছোপ বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেখা দিতে পারে যা একটি সাধারণ সমস্যা এবং এর কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পরার কোনও কারণ নেই। এই আঁচিলগুলিকে সেবোরিক কেরাটোসিস (Seborrheic Keratosis) বা SK বলা হয় যার সাথে ত্বকের ক্যান্সারের কোনো সম্পর্ক নেই। এর জন্য কোনো চিকিৎসা-ও নিস্প্রয়োজন। এগুলি সংখ্যায় কয়েকটি বা অনেকগুলি হতে পারে।
কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালুরু কেএমসি (KMC) হাসপাতালের কনসালটেন্ট ত্বক বিশেষজ্ঞ ডাঃ গাথা এম উপাদ্যা জানান যে সেবোরিক কেরাটোসিস (Seborrheic Keratosis) বার্ধক্য আঁচিল (Wisdom Wart) নামেও পরিচিত। তিনি আরও জানান যে এই আঁচিলের প্রকৃতি নির্ধারণ সময় থাকতেই হয়ে যায় এবং এর কারণে কোনো জটিলতা দেখা দেয় না। তিনি আরো জানান যে সৌন্দর্য সচেতন মানুষ আজকাল এগুলিকে চিকিৎসার মাধ্যমে নির্মূল করার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে থাকেন কারণ এগুলো সাধারণত মুখ, গলা বা শরীরের উন্মুক্ত স্থানে হয়।
কেরালার আরিকোড়ের এ্যাসটর মাদার হাসপাতালের ত্বক বিশেষজ্ঞ (dermatologist) ডাঃ আরিয়া জেমস্ বলেন যে SK অর্থাৎ সেবোরিক কেরাটোসিস (Seborrheic Keratosis) ত্বকের উপর একটি সাধারণ ক্যান্সার–মুক্ত স্ফীতি। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে SK-র প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পুরুষ এবং নারী দুজনের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা সমানভাবে দেখা দেয়।
সেবোরিক কেরাটোসিস (Seborrheic Keratosis) কেন হয়?
ডাঃ উপাদ্যা জানালেন যে এই আঁচিল সাধারণত ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। “বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সারা শরীরে এই বার্ধক্য আঁচিল দেখা দেয়। যারা চড়া রোদে কাজ করেন তাদের শরীরের যেই অঙ্গে সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে সেখানে বেশী দেখা দেয়। এই সমস্যার কোনো নির্দিষ্ট কারণ না থাকলেও সূর্য রশ্মির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের ফলে এটা হতে পারে।
ডাঃ জেমস জানালেন যে SK-র আর কোনো লক্ষণ থাকে না। এগুলি আকারে ডিম্বাকৃত, বাদামি বা কালো রঙের ত্বকের উপর আটকে থাকা স্ফীতির মতো হয়। সাধারণত এই স্ফীতি মুখ, গলা, মাথার ত্বক, স্তন আর বুকের কাছে, হাত, পা, এবং কখনো কখনো যৌনাঙ্গে দেখা দেয়।”
বেঙ্গালুরু নিবাসী চিত্রার প্রথম আঁচিলটি ঘাড়ের কাছে দেখা দিয়েছিল যা তিনি কয়েক মাস পরে লক্ষ করেছিলেন। “আমার স্বামী সাথে কথা বলার সময় তিনি আমার ঘাড়ে দেখা দেওয়া প্রথম আঁচিলটির কথা আমাকে জানিয়েছিলন। যদিও আমার স্বামী চাইছেন না যে আমি এটাকে নির্মূল করি, আমি আঁচিলটিকে নির্মূল করার কথা বিবেচনা করছি।”
ত্বকের অন্যান্য সমস্যা
ডাঃ উপাদ্যা একই ধরনের দেখতে ত্বকের সমস্যার বিষয়ে জানালেন যে সেবোরিক কেরাটোসিসের ক্ষেত্রে স্ফীতিগুলি ত্বকের উপর উঠে থাকে, মানে আপনি আঙ্গুল দিয়ে এর আকার স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারবেন। ত্বকের যদি কেবল রং পরিবর্তন (pigmentation) হয় তাহলে সেটা স্টাকো কেরাটোসিস(Stucco Keratosis) । কখনো ছোট বিন্দুর মত আঁচিলগুলি ত্বকের উপরে, বিশেষ করে গলার কাছাকাছি ঝুলে থাকে। এগুলিকে ডার্মাটোসিস প্যাপুলোজ নিগ্রা (Dermatosis Papulose Nigra) বলা হয়।
ডাঃ জেমস্ জানালেন যে ডার্মোস্কোপির (dermoscopy) মাধ্যমে সঠিক রোগ নির্ধারণ করা সম্ভব। আঁচিল যদি দেখতে অস্বাভাবিক হয় তাহলে বায়োপ্সি করা উচিত। “সেবোরিক কেরাটোসিসকে (Seborrheic Keratosis) তিল, আঁচিল, জড়ুল, মেলানোমা (Melanoma), মেলানোসাইটিক নেভাই (Melanocytic Nevi), পিগমেন্টেড বেসেল কার্সিনোমা (Pigmented Basal Carcinoma) এবং পিগমেন্টেড বায়েন্জ ডিজিজ (Pigmented Bowen’s Disease)-এর সাথে গুলিয়ে ফেলা সম্ভব।”
সেবোরিক কেরাটোসিস (Seborrheic Keratosis) আচমকা দেখা দিতে পারে। ডাঃ উপাদ্যার মতে যদি বুক, পিঠ, কুঁচকি, পেট ইত্যাদিতে এই ধরনের আঁচিল লক্ষ করেন তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিন। SK-র এই হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়াকে লেজার-ট্রেলাট (Laser-Trelat) বলা হয়।
ডাঃ জেমস্ এর মতে লেজার-ট্রেলাট (Laser-Trelat)-এ শরীরে আচমকা অগুন্তি আঁচিল দেখা দেয়, বিশেষ করে শরীরের উপরের অংশে, যা এডিনোকার্সিনোমা (adenocarcinoma) নামক এক ধরনের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে যা পাকস্থলী, মলাশয়, খাদ্যনালী, স্তন এবং ফুসফুসে ছড়ায়। কিছু ক্ষেত্রে লেজার-ট্রেলাট (Laser-Trelat)মাইকোসিস ফাংগয়দ্জে (Mycosis Fungoides) এবং সেজারি সিনড্রোম (Sezary Syndrome) এর উপসর্গ হতে পারে। এইসব ক্ষেত্রে টিউমারের পরীক্ষা করা উচিত।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন
ডাঃ উপাদ্যা বললেন “এই ধরনের আঁচিল সাধারণত মাসে একটা/দুটো করে বা বহু বছর ধরে বাড়তে পারে। সেবোরিক কেরাটোসিস (Seborrheic Keratosis)সনাক্ত করার সবচেয়ে ভালো উপায় হল ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া। তবে পরীক্ষা এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে রোগ নির্ধারণ হওয়া ভালো।”
ডাঃ উপাদ্যা-এর মতে চামড়ার উপর যে কোনো ধরনের রঙিন স্ফীতিতে যদি তীব্র চুলকানি হয়, রক্ত পড়ে, রং পরিবর্তন হয় অথবা রস ক্ষরণ হয় তাহলে সাথে-সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। এইসব মেলানোমা (melanoma) (ক্যান্সার)-র লক্ষণ হতে পারে। অবহেলা করলে এটি আকারে বাড়তে এবং সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সঠিক রোগ নির্ধারণের ফলে কোনো জটিলতা বা ঝুঁকি থাকে না।
ডাঃ জেমস্ জানালেন যে সেবোরিক কেরাটোসিস (Seborrheic Keratosis) কোনও বিপজ্জনক রোগ নয় কিন্তু এরকম কোনো স্ফীতি ত্বকে দেখা গেলে অবহেলা করা উচিৎ নয়। “এটা বিপজ্জনক কিনা সেটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। একই ধরনের দেখতে ত্বকের সমস্যা ত্বকের ক্যান্সার-ও হতে পারে। ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অবশ্যই নেওয়া উচিৎ যদি নতুন কোনো স্ফীতি দেখা দেয় বা পুরানো স্ফীতির আকার পরিবর্তন হয়।
সেবোরিক কেরাটোসিস (Seborrheic Keratosis) কীভাবে নির্মূল করা যেতে পারে?
ডাঃ উপাদ্যা জানালেন যে ডাক্তারের মনে যদি কোনো সন্দেহ থাকে তাহলে তিনি বায়োপ্সি করার পরামর্শ দিতে পারেন এবং রিপোর্টের ভিত্তিতে চিকিৎসা করা হয়। “সানস্ক্রিন ব্যবহার করলে রোগ সারা শরীরে ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা কিছুটা কম হলেও পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এই ধরনের আঁচিল একবার দেখা দিতে শুরু করলে সমস্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তবে পুড়িয়ে বা প্রত্যেক সপ্তাহে নাইটরোজেন থেরাপি দিয়ে যেই আঁচিলগুলি রয়েছে সেগুলিকে নির্মূল করা যেতে পারে। কিছু স্ফীতি বৈদ্যুতিক প্রবাহের মাধ্যমে অপসারিত করা যেতে পারে।”