আপনি কতবার হাসেন? যদি বলেন নিয়মিতভাবে, তাহলে জেনে রাখুন যে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে এটি আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, বিশেষ করে যদি আপনি একজন প্রবীণ নাগরিক হন।
প্রকৃতপক্ষে, প্রাণখোলা হাসি, থেরাপি হিসাবে কাজ করে – এটি চিকিৎসার একটি রূপ। লাফটার থেরাপিতে বিভিন্ন ধরনের কৌশল ব্যবহার করা হয়, যেমন হাস্যরস, যাতে ব্যথা এবং চাপ কম করা যায়। পরিণাম: এটি একজন ব্যক্তিকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।
তদুপরি, এর অন্যান্য লাভও রয়েছে: এতে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং খিদে বাড়ে, এবং ব্যক্তিদের শারীরিক ব্যায়াম করার জন্য উপযুক্ত করে তোলে।
একটি কেস স্টাডির কথা স্মরণ করে, মুম্বাইয়ের বাসিন্দা ডাঃ মদন কাটারিয়া হ্যাপিয়েস্ট হেলথকে জানালেন যে শহরের একজন অবসরপ্রাপ্ত কোম্পানি সেক্রেটারি, পিটি হিন্দুজা, ৭৩ বছর বয়সে তার লাফটার ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন। ডাঃ কাটারিয়া, যিনি একজন মেডিক্যাল ডাক্তার, সারা বিশ্ব জুড়ে লাফটার ক্লাবের প্রচারের জন্য “গিগলিংয়ের গুরু” হিসাবে পরিচিত। তিনি মহারাষ্ট্রের নাসিকে স্বাস্থ্যের জন্য হাসির প্রচারকারী একটি সংস্থা লাফটার যোগ ইন্টারন্যাশনালেরও প্রতিষ্ঠাতা।
ডাঃ কাটারিয়া জানালেন, “হিন্দুজার গম্ভীর ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন; তিনি কখনো হাসেননি। তিনি অনেক সংশয় নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন, কারণ তিনি হাসতে পারবেন কিনা এই নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল ।”
“মুম্বাইয়ে আমাদের লাফটার ক্লাবে যোগ দেওয়ার পর হিন্দুজা [প্রথম দিকে] ভয় পেয়েছিলন। তিনি খুব কমই হাসতেন। কিন্তু ধীরে–ধীরে তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং ছয় সপ্তাহ পর তিনি এমনভাবে হাসতে শুরু করলেন যেন কেউ তাঁকে দেখছে না। আমরা মুম্বাইয়ে একটি হাসির চ্যাম্পিয়নশিপ করেছিলাম এবং হিন্দুজা সেই চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হয়েছিলেন।”
ডাঃ কাটারিয়া জানালেন যে লাফটার থেরাপি হিন্দুজাকে তার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতেও সাহায্য করেছে।
ডিভাইন সোল যোগার শাখা দিল্লি এবং নেদারল্যান্ডসে রয়েছে। এর প্রতিষ্ঠাতা দীপক মিত্তাল হ্যাপিয়েস্ট হেলথকে বলেন যে লাফটার থেরাপি এক ধরনের কগনিটিভ বিহেভিয়ারল থেরাপি যা একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রার মান উন্নত করে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সম্পর্কগুলিকে সুস্থ করে তুলতে পারে।
তিনি বলেন, “যখন আমরা হাসি, তখন আমাদের মানসিক ভার হালকা হয়। এর ফলে শারীরিক পরিবর্তনও ঘটে। যদি একজন ব্যক্তি মানসিক চাপ, অপরাধবোধ বা ক্রোধ অনুভব করেন, তাহলে লাফটার নেতিবাচক আবেগ থেকে ফোকাস সরিয়ে আপনার মেজাজ ভাল করতে পারে।”
লাফটার থেরাপির উপকারিতা
মিত্তাল বলেন, লাফটার থেরাপি শারীরিক ব্যথা কমাতে সাহায্য করে এবং ক্যান্সারের মতো সাংঘাতিক রোগের সঙ্গে মোকাবিলা করতেও সাহায্য করে। “এটি একাকীত্বের সাথে লড়াই করতে এবং বিষণ্ণতার লক্ষণগুলি কম করতে পারে, কারণ হাসি অপ্রীতিকর বিষয়গুলির থেকে মনোযোগ সরাতে সাহায্য করে। এটি রক্তচাপও কমায়।” এছাড়াও, মিত্তাল জানান, হাঁপানি এবং ব্রঙ্কাইটিস রয়েছে এমন বয়স্কদের ক্ষেত্রে পেটের পেশী এবং ডায়াফ্রামকে কাজে লাগিয়ে হাসলে তা সুস্থ হতে সাহায্য করতে পারে।
বেঙ্গালুরুর মণিপাল হাসপাতালের জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের কনসালটেন্ট ডাঃ অনন্যা দাস হ্যাপিয়েস্ট হেলথকে বলেন যে লাফটার থেরাপি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। “হাসি স্ট্রেস হরমোন কমায় এবং অ্যান্টিবডির মাত্রা বাড়ায়, যার ফলে সংক্রমণের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়.”
মিত্তাল বলেন, লাফটার থেরাপি শরীরের কোষে অক্সিজেন বাড়ায়। “এছাড়া, এটি একটি শক্তিশালী কার্ডিওভাসকুলার ওয়ার্কআউটের কাজ করে, পেশীগুলিকে শক্তিশালী করে – বিশেষ করে বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে যারা শারীরিক ব্যায়াম করতে পারেন না। লাফটার থেরাপি সেলুলার এবং মলিকিউলার স্তরে একজন ব্যক্তির জৈবিক প্রক্রিয়াগুলিকে পরিবর্তন করে। এর ফলে পরিস্থিতি বা অবস্থান নির্বিশেষে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিকে সমর্থন করে।”
চিকিৎসকরা বলেন লাফটার থেরাপি হার্টকে রক্ষা করে যেহেতু হাসি রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে, রক্তচাপ কমায় এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক প্রতিরোধ করে।
ডাঃ দাস জানালেন, “হাসি এন্ডোরফিন বাড়ায়, যার ফলে ব্যথা এবং চাপ কমে। হাসি শরীরকে শিথিল করে এবং মনকে খুশি করে শারীরিক চাপ এবং উদ্বেগ কমায়। এতে মেজাজের উন্নতি ঘটে। লাফটার থেরাপির কোন সীমা নেই। বয়স্কদের যখনই সম্ভব হাসতে হবে এবং হাসার কারণ খুঁজতে হবে, যেমন টিভি দেখা, বাচ্চাদের সাথে খেলা করা এবং পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর সময়।”
ডাঃ কাটারিয়া হ্যাপিয়েস্ট হেলথকে বলেন যে হাসি শরীর এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ায় এবং ডিমেনশিয়ার প্রক্রিয়াকে ধীর করতে সাহায্য করে।
পদ্ধতি
ডাঃ কাটারিয়া জানালেন, “লাফটার থেরাপি বা লাফটার যোগা একটি অনন্য ধারণা। আমরা গ্রুপে হাসি। প্রথমে আমরা লাফটারকে ব্যায়ামের মতো সবাই মিলে করি। সময়ের সাথে, আমরা একে অপরের প্রতি ‘অকৃত্রিম‘ হয়ে উঠি, এবং লোকেরা সত্যিকারের হাসতে শুরু করেন।”
মিত্তাল বলেন, জোর করে বা স্বেচ্ছার হাসির স্বতঃস্ফূর্ত বা স্বাভাবিক হাসির মতোই মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক প্রভাব রয়েছে। স্বেচ্ছার হাসিতে দলের সকলে একে অপরের চোখে চোখ রেখে এবং খেলার ছলে হাসেন।
মিত্তাল আরও বলেন, “একবার স্বেচ্ছায় হাসতে শুরু করলে সেটা সত্যিকারের এবং সংক্রামক হাসিতে রূপান্তরিত হয়। মুখের পাশাপাশি, এতে মুখের অভ্যন্তরীণ নার্ভ এবং খাদ্যনালী, গলা, নাক, চোখ এবং গালের মতো শরীরের অঙ্গগুলির ব্যায়াম হয়। লাফটার থেরাপি মানে শরীর এবং মস্তিষ্কের ব্যায়াম।”
বিশেষজ্ঞরা জানালেন যে লাফটার থেরাপিতে ধাপ থাকে যা ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে চলে। প্রথমে, তালে তাল মিলিয়ে তালি বাজান। এতে আকুপ্রেসার পয়েন্টগুলি উদ্দীপ্ত হয়। তারপরে ডিপ ব্রিদিং করুন, যা ফুসফুসকে শিথিল করে এবং একজন ব্যক্তির মনকে উৎফুল্লিত করে। তারপর এদিক ওদিক হাত দুলিয়ে ছোট বাচ্চার মতো হাসুন। এতে সত্যিকারের এবং ছড়িয়ে পড়া হাসির রোল উঠে।
লাফটার থেরাপির প্রকার
লাফটার থেরাপি চার ধরনের হয়:
১। হিউমার থেরাপি: গ্রুপ সেশনের মাধ্যমে হাসির সঞ্চার হয়, যেমন মজার বই পড়ে এবং কমেডি শো এবং ফিল্ম দেখে।
২। ট্রিগার থেরাপি: এতে, থেরাপিস্ট প্রতিটি ব্যক্তির অনন্য ‘লাফটার ট্রিগার‘ চিহ্নিত করেন এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহার করেন।
৩। লাফটার যোগা: এটি যোগব্যায়াম, স্ট্রেচিং এবং নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মিশ্রণ যাতে হাস্যরসের থাকতে বা নাও থাকতে পারে।
৪। লাফটার মেডিটেশন: ধ্যান বলতে আমরা সাধারণতঃ যা বুঝি সেটার পরিবর্তে লাফটার মেডিটেশনের উদ্দেশ্য হলো একজন ব্যক্তিকে হাসানো এবং তাকে বর্তমানের দিকে মনোযোগ দিতে সাহায্য করা। ধ্যানরত অবস্থায় নীরবে হাসতে-হাসতে স্ট্রেচিং করা হয়।
ডাঃ কাটারিয়া বলেন, লাফটার থেরাপিতে হাসি-ভিত্তিক ব্যায়াম আছে। প্রাণায়ামের মতো কিছু শ্বাস-ভিত্তিক হাসির ব্যায়াম আছে যেখানে মানুষ একই সাথে শ্বাস নেয় এবং হাসে।
ডাঃ কাটারিয়া জানান, “কিছু ব্যায়াম প্রবীণদের আরও আমুদে বানানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও মূল্যবোধ–ভিত্তিক হাসির ব্যায়ামও আছে। এগুলোর মাধ্যমে অর্থ ও মূল্যবোধ প্রকাশ করা হয় — যেমন প্রশংসার হাসি এবং ক্ষমার হাসি।”