আপনার ওজন কমানোর যাত্রায় ভাল হজম এবং বিপাক নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা অর্জন করতে প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। পাশাপাশি খাবারের তালিকাও তৈরি করতে হবে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। উচ্চ প্রোটিন এবং ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে কম-কার্ব ডায়েট নিশ্চিত করা ছাড়াও খাদ্যতালিকায় অতিরিক্ত কিছুরও প্রয়োজন রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল চা। হ্যাঁ, চিনি ও দুধ ছাড়া বিভিন্ন উপায়ে চা খাওয়া যেতে পারে, যা আপনার ওয়েট লসের জার্নিকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
ব্যাঙ্গালোরের ফোর্টিস হাসপাতালের জিআই এবং ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি ডাঃ গণেশ শেনয়-এর মতে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা ডায়েটিশিয়ানের নির্দেশ মোতাবেক স্বাস্থ্যকর চা-সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক পানীয় বেছে নিলে ওজন কমানোর কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
সারজাপুরের মণিপাল হাসপাতালের ডায়েটিক্স ও পুষ্টি বিভাগের প্রধান ভারতী এনআর বলছেন, বাড়িতে তৈরি স্বাস্থ্যকর চায়ের মধ্যে বেশ কিছু প্রাকৃতিক উপাদান যোগ করলে ওজন কমাতে সাহায্য করে। কারণ, এগুলির বেশিরভাগই প্রদাহ বিরোধী এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। ফলে, হজম আরও ভাল ভাবে হতে পারে।
তাঁরা দুধ ও চিনি বাদ দিয়ে প্রাকৃতিক উপাদান যোগ করে এমনই কিছু চা খেতে বলছেন, যাতে সত্যিই ওজন কমে। সেরকমই ছয়টি ভিন্ন প্রকারের চা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
1) আদা চা
ডাঃ শেনয় বলছেন যে, আদা চা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টের প্রদাহ কমিয়ে দেয় এবং বদহজমের সমস্যাকে চিরতরে উধাও করে দিতে পারে। তার থেকেও বড় কথা হল, আদা আপনার ক্ষুধা দমন করতেও সাহায্য করে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী।
জলের সামান্য কিছু আদা কুচি ও তার সঙ্গে চা পাতা ফুটিয়ে খেতে পারেন। আবার অতিরিক্ত সুবিধার জন্য গ্রিন টি, লেবু জল, এমনকি অ্যাপেল সিডার ভিনিগারের সঙ্গেও মিশিয়ে খেতে পারেন, যা ওজন কমানোর জন্য অত্যন্ত কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ভারতী এনআর বলছেন, “আদা চা আপনার ফ্যাট বার্ন করতে, শরীরের বিপাকীয় হারকে উন্নত করতে পারে এবং ইমিউন সিস্টেমকেও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।” সেই সঙ্গেই আবার আদা চা আপনি পুষ্টি উপাদান হিসেবেও গ্রহণ করতে পারেন।
2) হলুদ চা
রান্নাঘরের অন্যতম পরিচিত মশলা হলুদ খাবারের স্বাদ বাড়াতে এবং প্রাণবন্ত রং যোগ করতে ব্যবহৃত হয়। তবে এই হলুদ আপনি চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ব্যাপক ভাবে উপকৃত হতে পারেন। কারণ, এর মধ্য রয়েছে কারকিউমিন যৌগ, যার একাধিক উপকারিতা রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মলিকুলার সায়েন্সে প্রকাশিত একটি পর্যালোচনা অনুসারে, কারকিউমিন-সহ প্রাকৃতিক পলিফেনল স্থূলতা পরিচালনার জন্য অত্যন্ত কার্যকর এবং নিরাপদ বিকল্প হতে পারে। সেখানে বলা হয়েছে, এনজ়াইম, শক্তি ব্যয়, অ্যাডিপোসাইট পার্থক্য, লিপিড বিপাক, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটা এবং কারকিউমিনের প্রদাহ বিরোধী সম্ভাবনা থাকার ফলে হলুদ মানুষের শরীরে স্থূলতা বিরোধী বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।
হলুদ চা প্রদাহজনক অন্ত্রের অবস্থা, যেমন ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS) বা প্রদাহজনক অন্ত্রের রোগ (IBD) পরিচালনা করতে সাহায্য করে। ডাঃ শেনয় বলেছেন, “এর প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলি পেটে ব্যথার মতো উপসর্গগুলিকেও উপশম করতে পারে।”
ডায়েটিশিয়ান ভারতী ব্যাখ্যা করেছেন যে, হলুদে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে এবং স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলির জন্য প্রতিদিন 1000 থেকে 1500 মিলিগ্রাম পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি আরও যোগ করে বলছেন, “এটি শুধুমাত্র ওজন কমাতেই সাহায্য করে না। বরং, আর্থ্রাইটিস এবং প্রদাহজনিত সমস্যা কমাতেও কাজে আসে হলুদ।”
3) পেপারমিন্ট টি
ভারতী বলছেন, “পেপারমিন্ট চা খুবই কম ক্যালোরিযুক্ত একটি পানীয়, যা ক্ষুধা নিবারণে সাহায্য করে এবং হজমশক্তি বাড়ায়।”
এই চা খেলে অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভাল থাকে এবং ফ্যাট বার্নের কাজও করে। তাই, দুধ চায়ের পরিবর্তে দিনে এক বা দুই কাপ পেপারমিন্ট চা খেলে ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে বলে জানাই ডায়েটিশিয়ান।
ডাঃ শেনয় বলছেন, “পেপারমিন্ট পাচনতন্ত্রের পেশিগুলিকে শিথিল করতে পারে এবং তার মধ্যে দিয়ে পেট ব্যথা এবং গ্যাস সহ ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোমের (আইবিএস) লক্ষণগুলি উপশম করতে পারে।”
4) ড্যান্ডেলিয়ন রুট টি
ড্যান্ডেলিয়ন রুট হল আপনার বাগানের বা বাড়ির আশপাশে থাকা একপ্রকারের আগাছা। ডাঃ শেনয় ব্যাখ্যা করছেন, ড্যান্ডেলিয়ন রুট ঐতিহ্যগতভাবে হজমকে উদ্দীপিত করতে ব্যবহৃত হয় এবং হজম সংক্রান্ত অস্বস্তিগুলিকেও দূর করতে পারে। তিনি আরও বলছেন, “এটি লিভার এবং গলব্লাডার ফাংশনকে সাপোর্ট করে ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়াগুলিতে সাহায্য করতে পারে।”
ড্যান্ডেলিয়ন রুটে আবার মূত্রবর্ধক যৌগও রয়েছে, যা জল ধারণ কমায় এবং আপনাকে অতিরিক্ত ওয়াটার ওয়েট বা জলের ওজন কমাতেও সাহায্য করে।
5) গ্রিন টি
আজকাল গ্রিন টি অনেকেই খেতে পছন্দ করেন। ডা শেনয় বলছেন, গ্রিন টি-এর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টগুলি অন্ত্রের আস্তরণকে প্রদাহ থেকে রক্ষা করতে পারে, যা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য খুবই উপকারী এবং ওজনও কমাতে পারে। তাঁর আরও বক্তব্য, “এর মধ্যে যে হাল্কা ক্যাফেইন রয়েছে, তা মৃদু উদ্দীপক হিসেবেও কাজ করতে পারে।”
যদিও গ্রিন টি সাধারণত বেশিরভাগ ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত। তবে, গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD), IBS বা অন্যান্য গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের একজন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
6) লেমন টি বা লেবু চা
“যখন আপনি দুধ চায়ের পরিবর্তে শুধুমাত্র লেবু চা পান করা শুরু করেন, তখন তা সাময়িকভাবে ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে। কারণ, শরীর থেকে টক্সিন বের হয়ে যায়। তবে, ধারাবাহিকভাবে ওজন কমানোর জন্য আপনাকে একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েট এবং প্রতিনিয়ত ব্যায়াম করতে হবে,” বলছেন ভারতী। একটি লেবু প্রায় 25 মিলিগ্রাম থেকে 30 মিলিগ্রাম ভিটামিন সি সরবরাহ করে।
লেবুর খোসায় পেকটিন রয়েছে। এটি একটি দ্রবণীয় ফাইবার, যা অন্ত্রের স্বাস্থ্য এবং ওজন কমানোর জন্য ভাল। লেবু ও আদা দিয়ে চা বিপাক প্রক্রিয়া দ্রুত করতে পারে এবং ওজন কমানোর জন্যও যথেষ্ট উপকারী। লেবুতে পাওয়া ভিটামিন সি, পিত্ত উৎপাদনে সহায়তা করতে পারে, যা চর্বি হজমের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
মোদ্দাকথা
দুধ ও চিনি দেওয়া চায়ের পরিবর্তে সাধারণ, প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি স্বাস্থ্যকর চা মানুষের ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে এই চা খাওয়ার আগে অবশ্যই ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিতে হবে। একজনের স্বাস্থ্যের অবস্থা অনুযায়ী এই ধরনের চা তাঁর শরীরের জন্য আদৌ ভাল কি না, তা একমাত্র ডায়েটিশিয়ানই বলতে পারেন।