পরের বার কোনও ওষুধের দোকান থেকে আপনি যখন ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ORS কিনবেন, তার লেবেলটি পড়তে যেন ভুলবেন না। ওষুধের দোকানের সেই ওআরএস WHO-এর প্রস্তাবিত সূত্র অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে কি না, তা যাচাই করে দেখুন। হালফিলে ডিহাইড্রেশনের জন্য বাজারে হরেক কিসিমের এনার্জি ড্রিঙ্ক বিক্রি হচ্ছে ORS-এর। অনেকের মধ্যেই একটা ধারণা থাকে যে, এই ধরনের পণ্যগুলি ডায়রিয়া-সহ অন্যান্য ক্লান্তিকর রোগের সময় খাওয়া নিরাপদ। বেশিরভাগ মানুষই লেবেল না পড়ে ডিহাইড্রেশনের জন্য এমনতর এনার্জি ড্রিঙ্কগুলি বেছে নেন, যেগুলির ব্যাপক ভাবে বিজ্ঞাপনও করা হয়। জেনে রাখা ভাল, এই ধরনের এনার্জি ড্রিঙ্কগুলি আপনার শরীর খারাপ করতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওআরএস এবং তার নামে বিক্রি হওয়া এনার্জি ড্রিঙ্কগুলির মধ্যে কীভাবে পার্থক্য করা যায়, তা জানাটা খুবই জরুরি।
ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ORS কী?
ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ORS হল চিনি এবং ইলেক্ট্রোলাইট দ্রবণ, যা ডিহাইড্রেশন, ডায়রিয়া এবং সংক্রমণের সময় ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কলকাতার ডাক্তারের মস্তিষ্কপ্রসূত
বর্তমানে সারা বিশ্বে ব্যবহৃত সহজ এবং অত্যন্ত কার্যকর এই প্রতিকারটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। 1971 সালে শরণার্থী শিবিরে ব্যাপক ভাবে কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় কলেরার কারণে প্রচুর শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। কলকাতার শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ দিলীপ মহলানবিশ এই সহজ সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ডায়রিয়াজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি আবিষ্কার করে লক্ষ লক্ষ শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন এই বাঙালি ডাক্তার।
ORS কীভাবে কাজ করে?
চেন্নাইয়ের প্রশান্ত হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ অনন্ত কৃষ্ণণ জানাচ্ছেন, চিনি ও লবণের সঠিক মিশ্রণ ও অনুপাতে তৈরি একটি সহজ সমাধান হল ওআরএস, যা প্রাথমিকভাবে ডায়রিয়ার কারণে সৃষ্ট ডিহাইড্রেশনের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। তিনি বলছেন, “যখন কারও ডায়রিয়া বা লুজ় মোশন হয়, তখন খুব সহজেই তাঁর অন্ত্র থেকে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড এবং বাইকার্বোনেট উপাদান বেরিয়ে যায়। সেই বেরিয়ে যাওয়া সোডিয়াম ও গ্লুকোজ় প্রতিস্থাপনের জন্যই রোগীদের ORS দেওয়া হয়।” WHO বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে এর মধ্যে থাকা বিভিন্ন উপাদানের আদর্শ অনুপাত নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, “ওআরএসে এক লিটার জলে 2.6 গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইড, 2.9 গ্রাম ট্রাইসোডিয়াম সাইট্রেট ডাইহাইড্রেট, 1.5 গ্রাম পটাসিয়াম ক্লোরাইড এবং 13.5 গ্রাম গ্লুকোজ থাকতে হবে।”
ডাঃ কৃষ্ণণ উল্লেখ করেছেন ওআরএস মূলত দুই ধরনের: একটি সাধারণ ওআরএস (পাউডার যা পরে জলে মেশানো হয়) এবং অপরটি অসমোলারিটি কমানো ওআরএস (তরল আকার)। তাঁর কথায়, “অসমোলারিটি হল এক লিটার তরলে দ্রবীভূত দ্রাবক। WHO দ্বারা সুপারিশকৃত প্রতিটি উপাদানের জন্য নির্দিষ্ট মান-সহ মোট 245 এর অসমোলারিটি থাকতে হবে। উল্লিখিত কম্পোজিশনের চেয়ে কম বা বেশি [দ্রাবক] হলে, সেই পণ্যকে ওআরএস বলে গণ্য করা হয় না।”
শিশুদের মধ্যে ডিহাইড্রেশন
গুরুতর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে রিহাইড্রেট করার ক্ষেত্রে ওআরএস খুবই কার্যকরী, জানালেন ডাঃ পারস কুমার জে, লিড কনসালট্যান্ট, নিওনাটোলজি অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক্স, স্পর্শ হসপিটাল ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন, বেঙ্গালুরু। তাঁর কথায়, “শিশুদের ডায়রিয়ার চিকিৎসার প্রধান ভিত্তি হল রিহাইড্রেশন এবং ওআরএস সে ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে কাজ করে।”
তবে কোনও শিশুর ডায়রিয়া যদি গুরুতর আকার ধারণ করে এবং ডিহাইড্রেশন থাকে, তাহলে তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে অতি অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে বলে জানালেন ডাঃ পারস কুমার জে।
শিশুদের মধ্যে গুরুতর ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ:
প্রস্রাব কমে যাওয়া: শিশু ছয় থেকে আট ঘণ্টার বেশি প্রস্রাব করে না।
শক্তি কমে যাওয়া: শিশুট খুব অলস এবং খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে।
শুষ্কতা: মুখ এবং চোখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া।
কোনটা ORS আর কোনটা নয়?
ডাঃ কৃষ্ণণ বলছেন যে, বেশ কয়েকটি কোম্পানি ওআরএসের নামে এনার্জি ড্রিঙ্কস বিক্রি করছে, যেগুলি আসলে ORS নয়। “শুধুমাত্র যখন WHO দ্বারা নির্ধারিত মান অনুযায়ী একটি সমাধান প্রস্তুত করা হয়, তখনই পানীয়টিকে ORS হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ORS নামে প্রাপ্ত বেশিরভাগ পানীয়ের সঠিক গ্লুকোজ-সোডিয়াম অনুপাত বা সোডিয়াম এবং পটাসিয়ামের পরিমাণ নেই,” যোগ করলেন তিনি।
* যেহেতু বেশিরভাগ ORS-ই স্বাদহীন, তাই অভিভাবকরা ORS লেবেলযুক্ত টেট্রা প্যাকগুলি বেশি করে বেছে নেন। “ওআরএসের নামে এনার্জি ড্রিঙ্কগুলিতে রং, অতিরিক্ত স্বাদ এবং সংরক্ষক যোগ করা হয়, যা শিশুদের জন্য মোটেই ভাল নয়,” বলছেন ডাঃ কৃষ্ণণ। ORS কেনার আগে তার লেবেল ভাল করে যাচাই করে নেওয়ার উপরে জোর দিচ্ছেন তিনি।
* এই প্যাকগুলির বেশিরভাগই WHO দ্বারা সুপারিশ করা হয় না এবং তাদের উপর একটি সতর্কতামূলক বিবৃতিও থাকে যে, এগুলি ORS নয় এবং ডায়রিয়ার সময় এক্কেবারেই খাওয়া উচিত নয়।
* ডাঃ পারস কুমার জে বলছেন, “এই পানীয়গুলির মধ্যে সাইট্রিক উপাদান থাকার ফলে বাচ্চাদের বমি-বমি ভাব বাড়তে পারে। আর বাচ্চারা বেশি বমি করলে তাদের শরীর জলশূন্য হয়ে যায়। তাই, সঠিক ওআরএস বেছে নেওয়াটা খুবই জরুরি।”
* ডাঃ কৃষ্ণণ আরও জানাচ্ছেন যে, কোনও ব্যক্তির যদি ডিহাইড্রেশন গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তাহলে বাণিজ্যিক ভাবে বিক্রি হওয়া ORS দিয়ে তাঁর চিকিৎসা করলে শরীরে সোডিয়াম এবং পটাসিয়ামের মাত্রা কমতে থাকে। তখন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করারও প্রয়োজন হতে পারে।
বাড়িতে ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ORS বানাবেন কীভাবে?
ডাঃ কৃষ্ণণ জানাচ্ছেন, একজনের লেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা পুনরুদ্ধার করতে বাড়িতেই ওআরএস বানানো যেতে পারে এবং তার একটি মাপকাঠিও ঠিক করে দিয়েছে WHO। ঘরে বসে ORS তৈরি করতে গেলে এক লিটার জলে ছয় চা চামচ চিনি, আধা চা চামচ লবণ মেশাতে পারেন।
তিনি আরও বলছেন, “ওআরএসে এক লিটার জলে নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণ ও গ্লুকোজ় থাকতে হবে। সেই সঙ্গে অবশ্যই জল যোগ করতে হবে। দুধ, ডাবের জল, জুস বা অন্য কোনও পানীয় ব্যবহার করা যাবে না ওআরএস তৈরি করার জন্য। অতিরিক্ত চিনিও যোগ করা উচিত নয়। শুধুমাত্র শক্তি দেওয়া নয়। গ্লুকোজ় দেওয়া হয়, সোডিয়াম শোষণ আরও সহজতর করার জন্য।”
বাড়িতে তৈরি ওআরএস পান করলে ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে সাহায্য করে। তবে ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ যদি হয় গুরুতর, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মোদ্দাকথা
ORS বা ওরাল রিহাইড্রেশন দ্রবণে লবণ এবং চিনি থাকে যা ডায়রিয়ার কারণে ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা পুনরুদ্ধার করে। বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হওয়া ORS-এর লেবেলগুলি পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ORS-এর নামে বিক্রি হওয়া সব কিছুতেই সঠিক ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালান্স থাকে না।