গর্ভাবস্থা এক সুন্দর অভিজ্ঞতা যার সাথে রূপকার্থে এবং আক্ষরিক অর্থে দুইয়েরই অনেক মূল্যবান মুহূর্ত এবং পরিবর্তন জড়িয়ে থাকে। পরিবর্তনগুলির সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, এই অবস্থায় একজন মহিলা যে শারীরিক সমস্যাগুলির মধ্যে দিয়ে যায় সেগুলি এবং তার সাথে জড়িত মানসিক সমস্যাগুলি ভয়ঙ্কর হতে পারে। যদিও এই পরিবর্তন এবং এর প্রভাব ব্যক্তিবিশেষে আলাদা হয়, তবুও বেশিরভাগ গর্ভবতী মহিলারা গর্ভাবস্থার সময়কালে কোনও না কোনও সময়ে পিঠের ব্যথা ভোগ করেন।
গর্ভাবস্থায় কেন পিঠে ব্যথা হয়?
৫০-৮০ শতাংশ মহিলারা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের কারণে গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যথা অনুভব করেন। “গর্ভাবস্থায় জরায়ুর আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে, শরীরের ওজনও বৃদ্ধি পায়, যার ফলে পেট সামনের দিকে ফুলে যায়,” জানালেন বেঙ্গালুরুর ব্যানারঘাটা রোডে অবস্থিত ফোর্টিস হাসপাতালের প্রসূতি-স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শদাতা এবং ফার্টিলিটি এবং ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন ডঃ উষা বিআর৷ “এর ফলে মেরুদণ্ডের কার্ভকে ভিতরের দিকে ঘুরিয়ে দেয়, যার ফলে লর্ডোসিস হয়, যার সরাসরি ফল হিসাবে দেখা দেয় পিঠে ব্যথা।”
বেঙ্গালুরুর এস্টার আরভি হাসপাতালের চিফ ফিজিওথেরাপিস্ট পলক ডেংলা বলেন, “লিগামেন্টের শিথিলতা হল আরেকটি বড় কারণ৷ “গর্ভাবস্থায় শরীরে রিলাক্সিন হরমোনের মাত্রা বাড়তে থাকে। লিগামেন্ট এবং পেশী শিথিল হওয়ার সাথে সাথে জয়েন্টগুলির উপর চাপ বৃদ্ধি পায়। এইভাবে, পিঠের পেশীগুলিতে টান পড়ে যায়।”
বসার ধরনে সমস্যা এবং চাপ হল পিঠে ব্যথার এমন কিছু কারণ যাকে আমরা সহজেই অবহেলা করে থাকি।
গর্ভাবস্থায় অত্যধিক পিঠে ব্যথা কোনও সমস্যার উপসর্গ হতে পারে
পিঠে ব্যথার প্রকৃতি এবং তীব্রতা নির্ভর করে মানুষের উচ্চতার পাশাপাশি তাদের শারীরিক কার্যকলাপ এবং ফিটনেস স্তরের উপর। জরায়ুর আকার এবং গর্ভকালীন বয়স (গর্ভাবস্থার দৈর্ঘ্য যা শেষ মাসিক চক্রের প্রথম দিন থেকে পরিমাপ করা হয়) -এরও একটি প্রভাব রয়েছে।
যদিও ডেংলা সতর্ক করে বলেন যে, “গর্ভাবস্থার প্রথম মাসগুলিতে তীব্র পিঠে ব্যথা অনুভূত হলে সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং তা একেবারেই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।” তিনি আরো বলেন, “এর সাথে যদি পেটে কিছুক্ষণ পর পর একটানা ক্র্যাম্প হয়, তখন অবশ্যই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে পরীক্ষা করানো উচিত কারণ এটি অকাল প্রসবের লক্ষণ।”
ডাঃ উষা বলেন, “জরায়ুর অবস্থানের ভিত্তিতে, কিছু মহিলা গর্ভাবস্থার প্রথম মাসগুলিতে পিঠে ব্যথা অনুভব করবেন”। কিন্তু লর্ডোসিস-জনিত পিঠে ব্যথা চার থেকে পাঁচ মাস পর শুরু হয়। এই ব্যথা তৃতীয় ত্রৈমাসিকের সময় বৃদ্ধি পায় এবং সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। প্রসবের সময় এর তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। যারা কমপক্ষে ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে ব্যায়াম শুরু করেন তাদের অত্যধিক পিঠে ব্যথা হয় না।
যদিও বেশিরভাগ স্ট্রেন এবং ব্যথা পিঠের নীচের অংশে হয়, তাও অনেক সময় তা প্যারাস্পাইনাল পেশী (পিঠ এবং তার নড়াচড়াকে সহায়তা করে যে পেশীগুলি), কোমরের পেশী এবং কুঁচকির গোলাকার লিগামেন্টেও দেখা দেয়।
গর্ভাবস্থায় পিঠের ব্যথা উপশম করার টিপস
ওরাল পেইনকিলার এবং টপিকাল ব্যথা রিলিভারগুলি যেন ব্যথা উপশম করার জন্য শেষ বিকল্প হিসাবে বাছা হয় – এগুলি শুধুমাত্র যখন প্রয়োজন তখনই নেওয়া উচিত। বরং গর্ভাবস্থায় পিঠের ব্যথা এড়াতে মানুষ অন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে। এর জন্য বিশেষজ্ঞরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন:
বসার ধরণ যেন যথাযথ হয়: “সঠিক বসার ধরণ বজায় রাখা, বসার জন্য এরগনোমিক চেয়ার ব্যবহার করা এবং কাজ করার সময় সোজা হয়ে দাঁড়ানো পিঠের ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে। তাছাড়াও, ডাঃ উষা জানান, “একটানা বসে থাকা বা না দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো — প্রয়োজনে বিরতি নিলে ব্যথা উপশম হবে”।
প্রয়োজনে সাপোর্ট ব্যবহার করুন: ডেংলা পরামর্শ দেন, “যদি আপনাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু কাজ করতে হয়, তাহলে সাহায্য পেতে একটি ফুটস্টুল ব্যবহার করুন”। “একই সঙ্গে ফুটস্টুলে দুটো পা রাখার বদলে, আপনি এক এক পায়ের জন্য সেটি বদলে বদলে ব্যবহার করতে পারেন। এতে পিঠের ভার কমে। ডেংলা আরো বলেন, “তাছাড়াও, বৃদ্ধি পেতে থাকা পেটের সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট বেলি ব্যান্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। “সঠিকভাবে ব্যবহার করলে, এটি পিঠে ব্যথা কমায়। তবে ঘুমানোর সময় এটি পরা উচিত নয়। বরং, এটি দিনের বেলায় ব্যবহার করা যেতে পারে।‘’ মাতৃত্বকালীন ব্যবহারের জন্য তৈরি বালিশগুলিও কাজে লাগে, তবে সবচেয়ে বেশি সহায়তা পাওয়ার জন্য সেগুলিও সঠিক ভাবে ব্যবহার করা উচিত।
পায়ে পরার চটিজুতো সতর্কভাবে নির্বাচন করুন: গর্ভবতী মহিলাদের পরলে অস্বস্তি হয় এমন উঁচু হিল এবং সম্পূর্ণ ফ্ল্যাট জুতো এড়িয়ে চলা উচিত। চিকিৎসা সংক্রান্ত বানানো কিছুটা বাঁকানো ছোট চটিজুতো পরলে দেহের ওজন সম্পূর্ণ পায়ের উপর ভারসাম্য বজায় রেখে পড়বে।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন: তবে সবকিছুর উপরে, গর্ভাবস্থায় পিঠের ব্যথা কমানোর জন্য ব্যায়ামই হল প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ বিকল্প।
পিঠের ব্যথা কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যায়াম
গর্ভাবস্থায় যে কোনও ধরনের ব্যায়াম করার আগে, আপনার ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ নিন। যে সমস্ত ব্যায়ামে প্যারাস্পাইনাল পেশিগুলি শক্তিশালী হয় তাতে পিঠের ব্যথা কমে।
ডেংলা জানান, “প্রাক প্রসবকালে অনুশীলন করার মতো অনেক ব্যায়াম আছে – যেমন প্রাক প্রসব পাইলেটস”। স্ট্রেচিং-এর ব্যায়ামও খুব উপকারী। ডাঃ ঊষা জানান, “ব্রিজ পোজ বা পেলভিক টিল্ট এবং ক্যাট অ্যান্ড ক্যামেল পোজ গর্ভাবস্থায় ভালো কাজ করে”।
প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটলে পিঠের ব্যথায় আরাম পাওয়া যায়। বেশি নড়াচড়া না করতে পারলে চেয়ারে বসেও ব্যায়াম করা যেতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে সাঁতারও খুবই উপকারী। ডেংলা জোর দিয়ে বলেন, “গর্ভাবস্থায় সাঁতার দেহের পেশী এবং জয়েন্টগুলিকে শিথিল হতে সহায়তা করে এবং গর্ভাবস্থার শেষ ত্রৈমাসিকেও সাঁতার কাঁটা নিরাপদ”।
ব্যায়াম করার সময়, অবশ্যই খুব ধীরে ধীরে একটানা শ্বাস প্রশ্বাস নিতে হবে। যে কোনো সময়ে যদি মনে হয় অতিরিক্ত স্ট্রেচিং করা হয়ে যাচ্ছে বা অস্বস্তি হচ্ছে তাহলে থেমে যাওয়া উচিত। ডেংলা বলেন, “লামাজে শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল, যা সচেতন ভাবে ধীর ও গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিতে উৎসাহিত করে, তা গর্ভবতী মহিলাকে শান্ত থাকতে এবং উদ্বেগ ও চাপ কমাতে সাহায্য করে, এবং যখন কেউ প্রসবের জন্য প্রস্তুত হন, তখনও এটি সহায়ক হতে পারে”।
সারসংক্ষেপ
- শারীরিক পরিবর্তনের কারণে প্রায় ৫০-৮০ শতাংশ মহিলা গর্ভাবস্থায় পিঠের ব্যথায় ভোগেন।
- শিথিলকারী হরমোন ও লর্ডোসিস এবং বসার ভঙ্গিতে সমস্যা ও চাপ পিঠে ব্যথার প্রধান কারণ।
- ব্যথা উপশম করার জন্য যে ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করা যায় সেগুলি হল নিয়মিত ব্যায়াম, বসা বা দাঁড়ানোর সময় সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা এবং উপযুক্ত চটিজুতো, বেলি ব্যান্ড, ফুটস্টুল এবং মাতৃত্বকালীন সময়ে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় বালিশ ব্যবহার করা।
- পেলভিক টিল্ট ও বিড়াল এবং উটের মত ভঙ্গিতে স্ট্রেচ এবং সেইসাথে হাঁটা এবং সাঁতারের মত ব্যায়াম দেহের পেশীকে শক্তিশালী করে এবং একইভাবে পিঠের ব্যথা কমায়।