সন্তানকে ডে-কেয়ারে পাঠানো বাবা-মায়েদের জন্য কষ্টকর হতে পারে। ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা প্রিয়া সাহার (৩২) ক্ষেত্রে তাঁর সন্তানকে ডে-কেয়ারে পাঠানো ছিল আবশ্যক কারণ তিনি দুই বছরের বিরতির পর কর্মক্ষেত্রে ফিরতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর মেয়েকে ২০১৯ সালের জুলাইতে ডে-কেয়ারে দেন, সে সময় তাঁর মেয়ের বয়স ছিল ২ বছর ৩ মাস। প্রিয়া জানান, “এর জন্য, আমি ওকে প্রায় তিন মাস ধরে প্রস্তুত করেছিলাম”। তাঁর মেয়ের ডে-কেয়ারে মানিয়ে নিতে দু’সপ্তাহ লেগেছিল।
কর্ণাটক কাউন্সিল অফ প্রি-স্কুলের সেক্রেটারি এবং একজন অভিজ্ঞ শিক্ষা সংক্রান্ত পরামর্শদাতা প্রুথ্বী বানওয়াসি পরামর্শ দেন যে, “বাড়ির মতো একটি ডে-কেয়ার সেন্টার বেছে নিন।” ডে-কেয়ারে মানিয়ে নেওয়ার জন্য একটি শিশুর প্রয়োজন ডে-কেয়ারে বাড়ির মতো পরিবেশ, কারণ সেখানে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তারা শুধুমাত্র তাদের বাবা-মা এবং ঠাকুর্দা-ঠাকুমার সঙ্গেই থেকেছে।
এই কথার সাথে সহমত হয়ে, মহারাষ্ট্রের নাগপুরের পেরেন্টিং সংক্রান্ত শিক্ষাবিদ এবং পারিবারিক পরামর্শদাতা হিমানি গুপ্তে, উল্লেখ করেন যে, “অভিভাবকদের অবশ্যই ডে-কেয়ারের পরিবেশ, সংস্থান শিশুটির জন্য উপযুক্ত কিনা এবং শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীরা শিশুটির দেখভাল করার জন্য যোগ্য কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।” তিনি আরো বলেন, “ডে কেয়ার, স্কুলের পরিপূরক। সুতরাং, পিতামাতাদের অবশ্যই তাদের সন্তানের জন্য ডে কেয়ার বেছে নেওয়ার সময় বিদ্যাচর্চার চেয়ে সামাজিক পরিবেশকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
কখন আপনার সন্তানকে ডে-কেয়ারে পাঠানো উচিত?
গুপ্তে উল্লেখ করেন, ডে-কেয়ারে বাচ্চাদের বয়স এক বছর এবং ছয় মাস থেকে ১২ বা ১৪ বছর পর্যন্ত হতে পারে (ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে)। দুই বছরের কম বয়সী বাচ্চারা সাধারণত, ডে কেয়ারে বেশি বয়সী বাচ্চাদের তুলনায় কম সময় কাটায়। তিনি আরো বলেন, “ডে কেয়ারে ভর্তি হওয়ার আগে শিশুকে প্রাথমিক যোগাযোগ দক্ষতা শিখতে হবে।”
ইউনাইটেড কিংডম, নরউইচের একজন গৃহিনী, লরা আভিস (৪৩), তার পুত্রসন্তানকে ২০২১ সালে যখন একটি ডে কেয়ারে ভর্তি করান তখন তার বয়স ছিল ২ বছর। তিনি বলেন, “আমার ছেলের মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিল। প্রথমদিকে কিছুদিন ডে-কেয়ারে এক বা দুই ঘন্টা থাকার পর, সে আস্তে আস্তে সেখানে গোটা দিন থাকতে শুরু করে।”
গোয়ার কানাকোনার হেলথ অ্যান্ড ইমোশনের প্রতিষ্ঠাতা গাইনোকোলজিস্ট এবং চাইল্ড সাইকোলজিস্ট ডাঃ রাজলক্ষ্মী পরামর্শ দেন যে কোনও শিশুকে তাদের ডে-কেয়ারে প্রথমদিন যাওয়ার আগের দিন সেখানে তাদের নিয়ে গিয়ে একবার ঘুরিয়ে আনলে তাদের অভিজ্ঞতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে। তিনি বলেন, “একটি শিশুকে প্রস্তুত করে রাখলে নতুন পরিবেশে তাদের চমক লাগে না। ধীরে ধীরে শিশুকে ঘরের থেকে আলাদা হওয়ার অনুভূতি বোঝানো গুরুত্বপূর্ণ।”
ডে-কেয়ারে শিশুসন্তান: পরিবর্তন কখনোই সহজ নয়
গুপ্তে বলেন, ডে কেয়ারে মানিয়ে নেওয়া একটি শিশুর জন্য সমস্যাজনক হতে পারে, কারণ তারা ধীরে ধীরে নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়। “সন্তানের প্রস্তুতি এবং স্বাচ্ছন্দ্যের স্তরই মুখ্য”। আভিস হ্যাপিয়েস্ট হেলথকে জানান, “প্রথমদিকে, আমার ছেলে চেয়েছিল যে আমি তার সাথে থাকি। কিন্তু, বেবি কেয়ার সেন্টারটি আমাকে আশ্বস্ত করেছিল যে সময়ের সাথে সাথে সে নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।”
নরওয়ের অসলোর গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত ২০২১ সালের একটি গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে একটি শিশু যখন বাড়ি থেকে ডে-কেয়ারে যায় তখন তার শরীরে উচ্চ মাত্রার কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) ক্ষরিত হয়। যখন তারা তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয় তখন তারা যথেষ্ট চাপ অনুভব করে এবং যখন তারা তাদের সাথে আবার মিলিত হয় তখন সন্ধ্যার দিকে হরমোনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
প্রিয়া বলেন যে তিনি ডে-কেয়ার থেকে চলে আসার সময় তাঁর মেয়ে সপ্তাহখানেক ধরে প্রায় প্রতিদিন কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করত। “যদিও, সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যে, আমার মেয়ে সহজেই আমায় বাই বলত। সেটা আমাকে আশ্বস্ত করেছিল,” তিনি জানান।
তাছাড়াও, ডে-কেয়ারে বাচ্চাদের পাঠালে মা-বাবারও মনখারাপ হতে পারে। লরা বলেন, তিনি চেয়েছিলেন যে তার ছেলে স্বাধীনতার স্বাদ পাক এবং ডে-কেয়ারে বন্ধু তৈরি করে এবং কিছু সামাজিক দক্ষতা (যেমন ভাগ করে নেওয়া এবং অন্যের কথা ভাবা) শিখে স্কুলের পরিবেশের জন্য প্রস্তুত হোক। তিনি বলেন, “তবে, যখন সে দরজায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য কাঁদছিল তখন মন শক্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল”। তিনি আরও জানান, সেখানকার কর্মীরা সারা দিন আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন এবং তার ফটো পাঠিয়েছিলেন, যাতে আমিও নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলাম।
আপনার সন্তানকে কীভাবে ডে-কেয়ারের জন্য প্রস্তুত করবেন?
গুপ্তে ব্যাখ্যা করেন, “বাবা-মায়েরা সন্তানকে কিছু সহজ বাক্য বলা শেখাতে পারেন, নিজে নিজে খেতে শেখাতে পারেন এবং টয়লেট যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে পারেন”। প্রিয়া বলেন, তাঁর একটা চিন্তা ছিল যে তাঁর মেয়ে বেবি কেয়ার সেন্টারে নতুন ভাষা আয়ত্ত করতে পারবে কিনা, কারণ সে শুধুমাত্র তার মাতৃভাষাটাই জানত। তিনি আরো বলেন “কিন্তু আমি অবাক হয়েছিলাম দেখে যে, সে সেখানে নতুন ইংরেজি এবং কানাড়া শব্দ শিখেছিল”।
বাবা-মায়েদের আরও একটি চিন্তা থাকে আর তা হল স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে। প্রিয়া বলেন, “আমার সন্তান ডে-কেয়ারে যেতে শুরু করার প্রায় এক মাস আগে থেকেই আমি তাকে হাত কীভাবে পরিষ্কার রাখতে হয় এবং কীভাবে টিফিন বাক্স থেকে খেতে হয় তা শিখিয়েছিলাম। যদিও, যেহেতু সে ভাল করে সবকিছু খেতে চাইত না, তাই আমি চেয়েছিলাম যাতে ডে-কেয়ারের কর্মীরা ওর খাওয়াদাওয়ার দিকে ভাল করে নজর রাখেন।”
গুপ্তের পরামর্শ অনুযায়ী, সন্তানকে তাদের ব্যাগ, জলের বোতল এবং টিফিন বাক্সের দায়িত্ব নিতে শেখান। এতে তাদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন আর দায়দায়িত্বের ধারণা তৈরি হয়।
শিশু যেন বাড়ির পরিবেশ পায় এবং নিরাপদ বোধ করে
বানওয়াসি বলেন, একটি শিশু যেন নতুন পরিবেশে স্বাগত বোধ করে। তিনি বলেন, “ডে-কেয়ার সবসময় যেন হয় ঘরোয়া, যাতে মনে হয় যে শিশুটি যেন কোনও পারিবারিক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছে অন্য শিশুদের সাথে খেলা করতে”। ডে-কেয়ারের কর্মীরা যেন প্রত্যেকটি শিশুর চাহিদা ভালোভাবে বোঝেন, সেদিকেও নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বাবা-মায়েদের পরামর্শ দেন শিশুদের পোশাক এবং খাবারের ব্যাপারেও সতর্ক হতে। তিনি বলেন, “যেহেতু এই বয়সে শিশুদের কৌতুহল তুঙ্গে থাকে, তাই আরামদায়ক পোশাক (যেমন ট্রাউজার, শর্টস বা টি-শার্ট) এবং সামান্য কিছু গয়না যা শিশুর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারে তাই পরানো উচিত। “তাছাড়াও, বাবা-মায়েরা যেন শিশুর জন্য তাজা, সদ্য রান্না করা খাবার তাদের সাথে দিয়ে দেন কারণ এতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং গ্যাস্ট্রোএন্টেরিক সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না”।
গুপ্তে বলেন, একটি শিশুকে ডে-কেয়ারে দেওয়ার আগে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন। এর মধ্যে পড়ে শিশুকে নিরাপদ ও অনিরাপদ স্পর্শের ধারণা সম্পর্কে জানানো এবং এমন ডে-কেয়ার বেছে নেওয়া যাতে অল্পসংখ্যক শিশু থাকে এবং জায়গাটিতে ক্যামেরা থাকে কারণ এতে বুলিইং-এর সম্ভাবনা নির্মূল করা যায়।
সারসংক্ষেপ
- বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের জন্য এমন ডে-কেয়ার নির্বাচন করা যা ঘরোয়া। তাছাড়াও, সেখানকার পরিবেশ, সম্পদ এবং শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীরা যেন শিশুটির দেখভালের জন্য উপযুক্ত হন সেদিকে মনোযোগ দেওয়া।
- বাবা-মায়েরা সন্তানকে ডে-কেয়ারের জন্য প্রস্তুত করতে কিছু সহজ বাক্য বলা শেখাতে পারেন, নিজে নিজে খেতে শেখাতে পারেন এবং টয়লেট যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে পারেন
- বাবা-মায়েদের উচিত শিশুর পোশাক ও খাবারের বিষয়ে সতর্ক থাকা। তাদের সন্তান যেন আরামদায়ক পোশাক পরে এবং তাদের জন্য যেন তাজা, সদ্য রান্না করা খাবার দেওয়া হয় সেদিকেও নজর দিতে হবে।